দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বিদেশে পাচার হচ্ছে

দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন বিদেশে পাচার হচ্ছে

নিজস্ব প্রতিবেদক : দেশ থেকে ক্রমাগত চুরি হয়ে যাচ্ছে প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। আন্তর্জাতিক প্রত্নসম্পদ চোরাকারবারিদের সক্রিয়তা এদেশে বেড়ে চলেছে। গত ৬ মাসে পাচারকারীদের কাছ থেকে শুধু কষ্টিপাথরের ৫টি মূর্তিই উদ্ধার করা হয়েছে। বিভিন্ন সময়ে গ্রেফতার হওয়া চোরাকারবারি চক্রের সদস্যদের দেয়া তথ্যের ভিত্তিতে বরাত দিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারীদের মতে, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাচারকারী চক্রগুলো মূলত দুটি অংশে কার্যক্রম চালায়। একটি অংশ স্থানীয়, অন্যটি বিদেশী। স্থানীয় অংশটির কাজ হলো প্রাচীন বিভিন্ন শহরের মানচিত্র ধরে ওসব এলাকা থেকে প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ চুরি ও পাচার করা। আর বিদেশী অংশটি আন্তর্জাতিক বাজারে ওসব প্রত্নসম্পদ বিক্রির কাজটি করে থাকে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বাংলার প্রাচীন জনপদ ও প্রত্নতাত্ত্বিক কেন্দ্রগুলো হাজার হাজার বছরের পুরনো সভ্যতার নিদর্শন বহন করে চলেছে। প্রাচীন জনগোষ্ঠী ও শাসকরা এ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আড়াই হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে অসংখ্য ইমারত, নগর, প্রাসাদ, দুর্গ, মন্দির, মসজিদ, বিহার, স্তূপ ও সমাধিসৌধ গড়ে তুলেছে। কিন্তু সময়ের বিবর্তনে ও যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এর অধিকাংশই বিলীন হয়ে গেছে। আর যেগুলো টিকে আছে ওই মহামূল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণে কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেই। চোরাকারবারিরা দীর্ঘদিন ধরেই এদেশের বিভিন্ন স্থান ও স্থাপনা থেকে প্রত্নসম্পদ চুরি ও বিদেশে পাচারে তৎপর রয়েছে। কিন্তু চলমান করোনা মহামারীতে প্রত্নসম্পদের নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতা বাড়ায় আন্তর্জাতিক চোরাকারবারি চক্রগুলোর সক্রিয়তাও বেড়েছে। চুরি হচ্ছে একের পর এক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। অবশ্য তার কিছু কিছু ধরাও পড়ছে।
সূত্র জানায়, সীমান্তরক্ষী বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ২০২০ সালের প্রথম ৮ মাসে (জানুয়ারি-অক্টোবর) সীমান্তপথে ভারতে পাচারকালে ৪টি কষ্টিপাথরের মূর্তি উদ্ধার করে। জুন থেকে অক্টোবরের মধ্যে উদ্ধার ৩টি মূর্তি। ওসব প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদের বেশির ভাগই ছিল কোনো না কোনো প্রাচীন মন্দির থেকে চুরি করা। মাটি দিয়ে তৈরি বিভিন্ন হস্তশিল্পসামগ্রীর সঙ্গে মিলিয়ে ওসব নিদর্শন পাচারের চেষ্টা করা হচ্ছিল। শুধু সীমান্ত নয়, রাজধানী থেকেও চুরি যাওয়া প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন উদ্ধার হচ্ছে। অতিসম্প্রতি বনানীর এক রেস্তোরাঁয় অভিযান চালিয়ে দুর্লভ কষ্টিপাথরের হস্তনির্মিত একটি বিষ্ণুমূর্তি উদ্ধার করে র?্যাব। কালো রঙের মূর্তিটির দৈর্ঘ্য সাড়ে ১৫ ইঞ্চি এবং ওজন ১০ কেজি। ওই সময় সেখান থেকে তিন সন্দেহভাজন চোরাকারবারিকেও গ্রেফতার করা হয়। র?্যাবের তথ্যানুযায়ী, গত এক যুগে শুধু র?্যাবই প্রত্নতত্ত্ব সংরক্ষণে ৩ শতাধিক অভিযান পরিচালনা করেছে। তাছাড়া গোয়েন্দাসহ পুলিশের অন্যান্য শাখা ও বিভাগও এ নিয়ে অনেক অভিযান পরিচালনা করেছে। ওসব অভিযানে উদ্ধার হওয়া নিদর্শনগুলো প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরে জমা দেয়া হয়েছে। তার মধ্যে অধিকাংশই প্রাচীন মূর্তি বা মূর্তির ভগ্নাংশ। তাছাড়া উদ্ধারকৃত নিদর্শনের তালিকায় প্রাচীন মুদ্রা, লিপিসহ অন্যান্য স্মারকও রয়েছে। ওসব মামলায় এখন পর্যন্ত চোরাকারবারি চক্রের অনেক সদস্য গ্রেফতার হলেও পরে জামিনে ছাড়া পেয়ে তারা আবারো একই পেশায় ফিরে যাওয়ার ঘটনাও অনেক ঘটেছে।
সূত্র আরো জানায়, বাংলাদেশ থেকে চুরি যাওয়া প্রত্নসম্পদের প্রথম প্রতিবেশী এক দেশ। সেখান থেকে ওসব মহামূল্যবান সম্পদ ইউরোপে নিয়ে যাওয়া হয়। প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের মূল ক্রেতা মূলত উন্নত দেশগুলোর ধনীরা। চড়া মূল্যে তারা ওসব সম্পদ সংগ্রহ করে। কিন্তু মহামারীসৃষ্ট নিরাপত্তা দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে ওসব চোরাকারবারি চক্র আরো অনেক বেশি সক্রিয় হয়ে উঠার আশঙ্কা করছে দেশের আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা রক্ষাকারী সংস্থাগুলো। র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মূল্যবান প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ চুরিতে বেশকিছু দেশী-বিদেশী চক্র সক্রিয় রয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে চক্রগুলো পরস্পর যোগসাজশে কষ্টিপাথরের তৈরি মূর্তি ও মূল্যবান দ্রব্য অবৈধভাবে পাচার করে আসছে। তবে তার মধ্যে কিছু চক্র আছে, যারা পুরনো মুদ্রা থেকে শুরু করে নানা ধরনের সামগ্রী অধিক মূল্যে বিক্রির প্রলোভন দেখিয়ে অনেকের সঙ্গে প্রতারণাও করে থাকে। তাদের বিরুদ্ধেও নজরদারি র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখার রয়েছে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তর প্রত্নতত্ত্বের নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হচ্ছে। তাদের দুর্বল নজরদারির কারণেই আন্তর্জাতিক চক্র স্থানীয় চক্রগুলোকে কাজে লাগিয়ে প্রত্নতাত্ত্বিক সম্পদ চুরি করিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক চক্রের সদস্যরা দেশে এসে বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে নিদর্শন খুঁজে লক্ষ্যও নির্ধারণ করে দিয়ে যাচ্ছে। ওসব নিদর্শন সংরক্ষণে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ জরুরি।
এ প্রসঙ্গে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও ঐতিহ্য অন্বেষণের নির্বাহী পরিচালক ড. সূফী মোস্তাফিজুর রহমান জানান, এ দেশীয় সংস্কৃতি অনেক পুরনো। সে সংস্কৃতির অংশ হিসেবে অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের সংগ্রহ ছিল। কিন্তু দুর্বল ব্যবস্থাপনা ও নিরাপত্তার কারণে ধীরে ধীরে অনেক নিদর্শন চুরি হয়ে গেছে। মহামূল্যবান এসব সম্পদ চুরি করার জন্য আন্তর্জাতিক চক্র সব সময়ই সুযোগ খুঁজতে থাকে। করোনাকালে দুর্বল নিরাপত্তার সুযোগে তারা আরো সক্রিয় হয়ে উঠেছে। কিছু প্রত্নসম্পদ পাচারের সময় উদ্ধার হলেও বেশির ভাগই চলে যায়। এ অবস্থায় সংশ্লিষ্ট অধিদপ্তরকে শক্ত ভূমিকা পালন করতে হবে। সেজন্য দ্রুত দেশের সব প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনের তালিকা করা জরুরি।
ংংং

Leave a reply

Minimum length: 20 characters ::

More News...

দুর্ঘটনার আশঙ্কায় জনমনে উদ্বগে বীরগঞ্জের সড়কগুলো দাপিয়ে বড়োচ্ছে কিশোর চালকরা

সন্দ্বীপে কৃষকের কাছ থেকে ধান কেনা উদ্বোধন