সাধন চন্দ্র মণ্ডল : ভারতীয় পণ্য পরিবহনে বাংলাদেশের সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ প্রতি টন কিলোমিটারপ্রতি দুই টাকা ফি নির্ধারণ করেছে। কিন্তু ভারত ওই ফি দিতে নারাজ। ভারত ফি-মুক্ত অথবা স্বল্প ফি’তে পণ্য পরিবহন সুবিধা চায়। তবে সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) মতে, ভারতীয় পণ্য পরিবহনে রাস্তার ক্ষতি ও পরিবেশদূষণ বাড়বে। তাই তাদের ফি দিতে হবে। কিন্তু ভারত বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, মোংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে বাংলাদেশের অভ্যন্তর দিয়ে দেশটির উত্তর-পূর্বের রাজ্যগুলোতে পণ্য পরিবহনে সড়ক ব্যবহারের ফি প্রশ্ন তুলেছে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তর (সওজ) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, বাংলাদেশের ট্রাক সমুদ্রবন্দর থেকে ভারত সীমান্ত পর্যন্ত পণ্য পরিবহন করার যুক্তিতে সড়ক ফি নির্ধারণের বিপক্ষে ভারত। কিন্তু সওজ’র মতে, ভারতীয় পণ্য পরিবহনের ফলে সড়কে বাড়তি যানবাহন চলবে। তাতে সড়কের ক্ষয় বাড়বে এবং আয়ুস্কাল কমবে। আর ওই ক্ষতি পোষাতে সড়কের রক্ষণাবেক্ষণ খরচ বাড়বে। সেজন্যই সড়ক ব্যবহারের ফি নির্ধারণ যৌক্তিক। ইতঃপূর্বে ভারতের আসাম থেকে বাংলাদেশের সিলেট ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে ত্রিপুরা পর্যন্ত জ¦ালানি পরিবহনে ফি আদায় করা হয়েছে। বিগত ২০১৮ সালের অক্টোবরে সই হওয়া চুক্তিতে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহারের সুবিধা পেয়েছে ভারত। পরীক্ষামূলক যাত্রা হিসেবে গত জুলাইয়ে কলকাতা বন্দর থেকে ডাল ও টিনবাহী জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে আসে। পণ্য খালাসের পর তা ট্রাকে বাংলাদেশের সড়কপথে আখাউড়া বন্দর হয়ে ভারতের ত্রিপুরায় পাঠানো হয়। পরীক্ষামূলক ট্রানজিটের পর ৫ মাসে কোনো পণ্য পরিবহন হয়নি।
সূত্র জানায়, চুক্তি অনুযায়ী ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে পাঠানো পণ্য চট্টগ্রাম ও মোংলায় খালাসের পর বাংলাদেশের নির্ধারিত ৮টি সড়কপথ ব্যবহার করে স্থলবন্দর হয়ে আসাম ও ত্রিপুরায় যাবে। গত বছরের ডিসেম্বরে দু’দেশে নৌ সচিব পর্যায়ের আন্তঃসরকার কমিটির (আইজিসি) বৈঠকে সড়ক ব্যবহারের ফি নির্ধারণে আলোচনা হয়। বাংলাদেশ প্রতি টন পণ্য পরিবহনে কিলোমিটারে দুই টাকা ফি নির্ধারণের প্রস্তাব করে। ওই হিসাবে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ফেনী-কুমিল্লা হয়ে আখাউড়া বন্দর পর্যন্ত ২৩০ কিলোমিটার পথে ১৫ টনের মাঝারি ট্রাকের পণ্য পরিবহনে ভারতকে ৬ হাজার ৫৬০ টাকা ফি দিতে হবে। আর চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া হয়ে সিলেটের শেওলা স্থলবন্দর দিয়ে ভারতের আসামে পণ্য পরিবহনে ৪২৭ কিলোমিটার পথে ১৫ টনের ট্রাককে ১০ হাজার ৩৬০ টাকা মাশুল দিতে হবে। তাছাড়া মোংলা বন্দর থেকে গোপালগঞ্জ-মাওয়া-ঢাকা-নরসিংদী, আশুগঞ্জ-সিলেট হয়ে শেওলাবন্দর দিয়ে আসামে পরিবহনে ৪৯৪ কিলোমিটার রাস্তা ব্যবহারে ১২ হাজার ৭২৫ টাকা ফি দিতে হবে। আর মোংলা থেকে তামাবিল বন্দর হয়ে ১৫ টন পণ্য পরিবহনে ফি নির্ধারণ করা হয়েছে ১৩ হাজার ১৭৫ টাকা।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশের রাজস্ব বোর্ড ভারত বাংলাদেশের সড়ক ব্যবহারের ফি ছাড়াও পণ্য পরিবহনে ডকুমেন্ট চার্জ ৩০ টাকা, প্রতি টনে ট্রান্সশিপমেন্ট চার্জ ২০ টাকা, প্রতি টনে সিকিউরিটি চার্জ ১০০ টাকা, প্রতি টনে এস্কর্ট চার্জ ৫০ টাকা, প্রতি টনে প্রশাসনিক চার্জ ১০০ টাকা, প্রতি কনটেইনারে স্ক্যানিং ফি ২৫৪ টাকা নির্ধারণ করেছে। তাছাড়া ইলেক্ট্রিক লক ও সিল বাবদ প্রতি টনে প্রথম ৪৮ ঘণ্টায় ৬০০ টাকা এবং পরবর্তী প্রতি ঘণ্টার জন্য ৫০ টাকা প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে সড়ক ব্যবহারের মাশুল ছাড়াও ‘ইলেক্ট্রিক লক ও সিল’ ফি নিয়েও ভারতের আপত্তি রয়েছে।
সূত্র আরো জানায়. ভারত সড়ক ব্যবহারের উচ্চ ফি নিয়ে আপত্তির কথা সরকারের উচ্চ পর্যায়ে জানিয়েছে। দেশটির যুক্তি- ট্রানজিটে বৈষম্যমূলক আচরণ নিষিদ্ধ। প্রতি টন পণ্যের জন্য কিলোমিটারপ্রতি ২ টাকা ফি বৈষম্যহীন নীতির সঙ্গে সংগতিপূর্ণ নয়। ভারতীয় পণ্য সমুদ্রবন্দরে খালাসের পর বাংলাদেশের ট্রাকে সড়কপথে ভারতে যাবে। ভারতের ট্রাক বাংলাদেশে ঢুকবে না। বাংলাদেশের ট্রাক সড়ক ব্যবহারের জন্য নিবন্ধিত। ট্রাকের মালিক-শ্রমিকের সঙ্গে পণ্যের আমদানি-রপ্তানিকারকের আলোচনায় ভাড়া নির্ধারণ করা যেতে পারে। তাছাড়া বন্দরে এক দফা নির্ধারিত মাশুল দিতে হবে। তারপর সড়কে মাশুল নিলে ব্যয় বেড়ে যাবে। তাতে আমদানি-রপ্তানিকারকরা ট্রানজিট ব্যবহারে আগ্রহ হারাবে। চট্টগ্রাম বন্দরে অন্য দেশের জাহাজে আসা পণ্যের টনপ্রতি ডকুমেন্ট ফি মাত্র ১০ টাকা। কিন্তু ভারতীয় পণ্যের জন্য তা টনপ্রতি ৩০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। তাছাড়া সিকিউরিটি ফি ১০০ টাকা নির্ধারণ নিয়ে আপত্তি তুলেছে ভারত।
এদিকে প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা বাংলাদেশ-ভারতের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কের দৃষ্টিকোণ থেকে সড়ক ফি’র বিষয়টি বিবেচনা করতে সওজকে চিঠি দিয়েছেন। ওই চিঠির মতামত দিয়ে সংস্থাটি জবাবে বলেছে, দুই দেশের চুক্তির ৮ ধারা অনুযায়ী সড়ক ফি আদায়ের সুযোগ রয়েছে। আর ২০১৪ সালের টোল নীতিমালা অনুযায়ী ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। অর্থনৈতিক ও গাণিতিক বিশ্নেষণের মাধ্যমে ১৫ টনের ট্রাকে প্রতি কিলোমিটারে ফি এক টাকা ৮৫ পয়সা। এর সঙ্গে পরিবেশ ও শব্দদূষণ মাশুল যোগ করে প্রতি টন পণ্য পরিবহনে প্রতি কিলোমিটারে দুই টাকা ফি ধরা হয়েছে।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান ২০১১ সালে ট্রানজিট কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি জানান, সড়ক ব্যবহারের ফি নির্ধারণ খুবই যৌক্তিক। বাংলাদেশের বন্দর ও সড়ক ব্যবহারের সুবিধা পাওয়ায় ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে কম সময় ও খরচে পণ্য উত্তর-পূর্ব রাজ্যগুলোতে যাচ্ছে। ওসব পণ্য পরিবহনে বাংলাদেশের সড়কে গাড়ির চলাচল বাড়বে। তাতে সড়ক দ্রুত ক্ষয় হবে। বাড়বে দূষণও। সড়ক রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিবেশদূষণ রোধে অবশ্যই ফি দিতে হবে। তবে টোল কমাতে ভারতের প্রচেষ্টা খুবই স্বাভাবিক। কারণ যে কেউই কম খরচে পণ্য পরিবহন করতে চাইবে। বিবিআইএন চুক্তি কার্যকরের পর বাংলাদেশের পণ্যবাহী গাড়ি ভারতে চলবে। তাই এমন ফি নির্ধারণ করতে হবে, যাতে ভবিষ্যতে বাংলাদেশি পণ্যবাহী গাড়ির জন্য চাপ তৈরি না হয়। তাছাড়া ভারতের পণ্য পরিবহনে যে অর্থ পাওয়া যাবে তা দিয়ে সড়ক রক্ষণাবেক্ষণে প্রথক তহবিল করা যেতে পারে।