নিজস্ব প্রতিবেদক : বিজয়ের ৪৯তম বার্ষিকীতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় মৌলবাদ ও সা¤প্রদায়িকতা প্রতিহতের অঙ্গীকারের মধ্য দিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে আজ বুধবার মহান বিজয় দিবস উদযাপিত হয়েছে।
নয় মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিশ্ব মানচিত্রে বাংলাদেশ নামে একটি নতুন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটে। সেই বিজয়ের ৪৯তম বার্ষিকী বুধবার রাজধানী ঢাকাসহ সারাদেশে এবং বিদেশে বাংলাদেশের বিভিন্ন দূতাবাসের উদযাপিত হয়েছে।
সকালে সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে কৃতজ্ঞচিত্তে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের বিনম্র শ্রদ্ধা জানানো হয়। শোক আর রক্তের ঋণ শোধ করার অঙ্গিকার ব্যক্ত করার মধ্য দিয়ে উজ্জীবিত জাতি দিবসটি উদযাপন করে অন্য রকম অনুভূতি নিয়ে।
সকালে শীতের কুয়াশা ও ঠান্ডা উপেক্ষা করে সর্বস্তরের মানুষ সাভারে স্মৃতিসৌধের বাইরে ও আশপাশের মহাসড়ক এলাকা এবং ধানমন্ডিস্থ বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে সমবেত হতে থাকে।
করোনা মহামারির মধ্যেও ভোরের সূর্য ওঠার আগেই ফুল, কপালে বিজয় দিবস লেখা ফেট্টি বেঁধে, জাতীয় পতাকা নিয়ে স্মৃতিসৌধে নামে জনতার ঢল। বিন¤্র চিত্তে সমগ্র জাতি ত্রিশ লাখ শহীদকে আরো একবার জানিয়ে দিল ‘আমরা তোমাদের ভুলবো না।’
দিবসটি উপলক্ষে সরকারি-বেসরকারি ভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়। জাতীয় প্যারেড গ্রাউন্ডে ভোরে ৩১ বার তোপধ্বনির মধ্য দিয়ে বিজয় দিবসের কর্মসূচি শুরু হয়।
বুধবার সকাল ৬টা ৩৪ মিনিটে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে সাভারে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শহীদ মুক্তিসেনাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। রাষ্ট্রপতির পক্ষে তাঁর সামরিক সচিব মেজর জেনারেল এস এম শামিম উজ জামান ও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল নকিব আহমদ চৌধুরী শহীদ বেদীতে পুষ্পস্তবক অর্পণ করেন।
এ সময়ে সশস্ত্র বাহিনীর একটি চৌকস দল সামরিক কায়দায় সালাম জানায়। শহীদদের স্মরণে বিউগলে বাজানো হয় করুণ সুর।
অন্যবছর রাষ্ট্রপ্রতি ও প্রধানমন্ত্রী বিজয় দিবসে সাভারে গিয়ে জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। কিন্তু করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে অন্য রাষ্ট্রীয় কর্মসূচির মতো এবারের বিজয় দিবসের কর্মসূচিও সীমিত করা হয়েছে।
রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর পক্ষেও শহীদ বেদীতে ফুল দেওয়া হয়।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের নেতৃত্বে মন্ত্রিসভার পক্ষথেকে স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়। এ সময়ে সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ, দুর্যোগ ও ত্রাণ প্রতিমন্ত্রী ডা. এনামুর রহমানও তার সঙ্গে ছিলেন।
এছাড়াও বীরশ্রেষ্ঠদের পরিবার, যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, প্রধান বিচারপতি ও তিন বাহিনীর পক্ষ থেকে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা জানান মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্ম শতবার্ষিকীতে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর সামনে দাঁড়ানো বাংলাদেশে। এবারের বিজয়ের উৎসব বড় পরিসরে উদযাপনের কথা থাকলেও করোনার কারণে সকল ধরনের কর্মসূচি সংক্ষিপ্ত করা হয়। তাই, উৎসবের পরিসর হয়েছে সীমিত, আর যেসব কর্মসূচি রয়েছে, তাতে অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রেও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার উপর জোর দেওয়া হয়েছে সরকারের পক্ষ থেকে।
আওয়ামী লীগ ভোরে সূর্যোদয়ের ক্ষণে দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে, বঙ্গবন্ধু ভবন ও দেশব্যাপী সংগঠনের কার্যালয়ে জাতীয় পতাকা ও দলীয় পতাকা উত্তোলন করে। সকাল ৯টায় জাতীয় স্মৃতিসৌধে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা শ্রদ্ধা জানান বীর শহীদের প্রতি।
এ সময়ে আওয়ামী লীগে সভাপতিমন্ডলীর সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী, ড. আব্দুর রাজ্জাক, জাহাঙ্গীর কবির নানক, শাজাহান খান ও আব্দুর রহমান, তথ্যমন্ত্রী ও দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ ও আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন, এস এম কামাল হোসেন ও মির্জা আজম, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, সংস্কৃতি বিষয়ক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল, শ্রম বিষয়ক সম্পাদক হাবিবুর রহমান সিরাজ, স্বাস্থ্য বিষয়ক সম্পাদক ডা. রোকেয়া সুলতানা, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক আবদুস সবুর, উপ দফতর সম্পাদক সায়েম খান প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা ও বিজয় উল্লাসে জাতীয় স্মৃতিসৌধ চত্বর মুখর ছিল বিভিন্ন বয়সী মানুষের পদচারণায়। স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির ধ্বংসাত্মক, নৈরাজ্যকর কর্মকান্ড প্রতিহত করতে নানা স্লোগান, দেশাত্মবোধক গান, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ বেজে চলছিল বিরামহীন ভাবে। জাতীয় স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা জানাতে আসা জনতার এই ঢল অব্যাহত থাকে বেলা ১ টা পর্যন্ত।
একে একে বেদীতে শ্রদ্ধা জানায় কেন্দ্রীয় ১৪ দল, শহীদ পরিবারের সন্তান ও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা। বিএনপি, গণফোরাম, যুক্তফ্রন্ট, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি জাতীয় স্মৃতিসৌধে শহীদদের প্রতি বিন¤্র শ্রদ্ধা জানায়।
এ ছাড়া আওয়ামী যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, ছাত্রলীগ, কৃষক লীগ, যুব মহিলা লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, তাঁতী লীগ, জাতীয় পার্টি (জেপি), ছাত্র ইউনিয়ন, যুব ইউনিয়ন, উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম-মুক্তিযুদ্ধ-’৭১, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, জাকের পার্টি, মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদসহ বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও বিভিন্ন হলের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরাও স্মৃতিসৌধে শহীদদের প্রতি প্রদ্ধা জানায়।
পরে মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ধানমন্ডিন্থ ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে রক্ষিত জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে দলীয় নেতাদের নিয়ে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জাতির পিতার প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হয়। দলের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীরা এ সময় বঙ্গবন্ধুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
এ ছাড়াও গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধি সৌধে দলের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
মহান বিজয় দিবস উপলক্ষে বিকেলে বঙ্গবন্ধু এভিনিউস্থ আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। আলোচনা সভায় ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বক্তব্য রাখেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
এদিকে, জাতীয় প্রেসক্লাবে স্থাপিত বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা নিবেদন করে জাতীয় প্রেসক্লাব, বিএফইউজে-বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন, ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়ন, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান সাংবাদিক ফোরাম, ইয়োথ জার্নালিস্ট ফোরামসহ বিভিন্ন সংগঠন।
দিবসটি উপলক্ষে সকল সরকারি-আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও বেসরকারি ভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনায় আলোকসজ্জা করা হয়। রাজধানী ঢাকা ও দেশের বিভিন্ন শহরের প্রধান সড়ক ও সড়ক দ্বীপগুলো জাতীয় পতাকা ও রঙ-বেরঙের পতাকায় সাজানো হয়।
শহীদদের আত্মার শান্তি, জাতির শান্তি, সমৃদ্ধি ও অগ্রতি কামনা করে মসজিদ, মন্দির, গির্জা, প্যাগোডাসহ সব ধর্মের উপাসনালয়ে বিশেষ মোনাজাত ও প্রার্থনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। হাসপাতাল, জেলখানা, বৃদ্ধাশ্রম, এতিমখানা, শিশু পরিবার ও ভবঘুরে প্রতিষ্ঠানগুলোতে উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করা হয়।