জানা যায়, ১৯৭৩ সালে হঠাৎ করেই সরকারের রক্ষীবাহিনীর নজিরবিহীন বৈরী আচরণ ও রিলিফ কমিটির চেয়ারম্যান-মেম্বারদের দৌরাত্ম্য ছাড়াও জোতদার-মজুদদারের দৌরাত্ম্য শুরু হয়। রিলিফ কমিটির দায়িত্বপ্রাপ্তরা নির্দ্বিধায় রিলিফের টিন, কম্বল, চাল, গমসহ টাকা আত্মসাৎ করে রাতারাতি আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ হয়ে যেতে থাকে। এছাড়াও জোতদার মজুদদারের অত্যাচারে মানুষ হারাতে বসে সর্বস্ব। রক্ষিবাহিনী ও মজুতদার-জোতদারের অসৎ উর্পাজনে নেমে আসে বরেন্দ্র এলাকার খেটে খাওয়া কৃষক সমাজের মধ্যে হাহাকার।এসময় রাজশাহী জেলার তানোর, গোদাগাড়ী ও পবা থানাসহ নওগাঁ জেলার মান্দা থানায় প্রগতিশীল কৃষক আন্দোলনের বিল্পবী নেতা এরাদ আলী ও এমদাদুল হক মন্টু মাস্টারের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে অন্যায়ের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ। রিলিফ পাচারকালে অত্র এলাকার বহু চেয়ারম্যান-মেম্বাররা ধরা পড়ে কৃষক জনতার হাতে। গণ-আদালতে তাদের বিচার করা হয়। জোতদার ও মজুদারের গোলার ধান নামিয়ে বিতরণ করা হয় হত দরিদ্র জনতার মধ্যে।
এছাড়াও জোতদার ও মজুদারের বেনামী রাখা জমি ও খাস জমি বিতরণ করা হয় ভূমিহীনদের মধ্যে। ওই সময়ের সরকার দলীয় নেতাদের দৌরাত্ম্য ও রক্ষীবাহিনীর নজিরবিহীন লুটপাট, ধর্ষণসহ বিভিন্ন অত্যাচারের বিরুদ্ধে আবার স্বাধীনতা সংগ্রামের সৈনিক এরাদ আলী ও ৭১ সালের রনাঙ্গনের কমান্ডার এমদাদুল হক বাবু ছাড়াও মন্টু মাষ্টারের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে সশস্ত্র প্রতিরোধ। তখন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বাঁচার পথ পায় বরেন্দ্রবাসিরা।
কৃষক আন্দোলনের বিল্পবী নেতা এরাদ আলী ১৯৬৯ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষায় পাশ করে কলেজে ভর্তি হয়ে ছাত্র জীবনে ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধার সৈনিক হয়ে যুদ্ধ করেছিলেন। এরপর নবগঠিত তৎকালীন সরকারের অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে তার নেতৃত্বে তানোরে গড়ে ওঠে সশস্ত্র কৃষক জনতার গণ অভ্যুত্থান। তবে তৎকালীন সরকার রক্ষীবাহিনী নামিয়ে গণঅভ্যুত্থানের নেতাদের ওপর শুরু করে অমানবিক অত্যাচার। ওই নেতাদের বাড়ি-ঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। বহু মা-বোন ধর্ষিত হয়।
এছাড়াও তাদের আত্যাচারে অনেক মানুষ পঙ্গুত্ব বরণ করে। রক্ষীবাহিনীর অসহনীয় অত্যাচারের পরেও সারা দেশের অত্যাচারকে হার মানিয়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে সশস্ত্র কৃষক জনতার গণ অভ্যুত্থানের নেতারা।
এরপর আন্দোলন দমাতে নামানো হয় তৎকালীন সরকারের সেনাবাহিনী। ওই সেনা কর্মকর্তাদের পাঠানো হয় সশস্ত্র কৃষক জনতার গণঅভ্যুত্থান ঠেকাতে। কয়েকটি লড়াইয়ের পর ১৯৭৩ সালে ১০ ডিসেম্বর নওগাঁ জেলার মান্দা থানার তেঁতুলিয়ার লড়াইয়ে আটক করা হয় সশস্ত্র কৃষক জনতার গণ অভ্যুত্থানের তানোরের ৩৭ জন নেতাকর্মীকে।
এছাড়াও ওই একই দিনে রাজশাহীর তানোর থানার শিবনদীর পশ্চিম পাড়ে বাতাসপুর গ্রামে আটক করা হয় কৃষক আন্দোলনের শীর্ষ স্থানীয় বিল্পবী ১১ জন নেতাকে। আর মান্দা থানায় যাদের আটক করা হয় তাদের মান্দা থানার কালিসাবা সেনা ক্যাম্পে নেওয়া হয় এবং তানোরের ১১ জনকে তানোর ডাকবাংলো সেনা ক্যাম্পে আটক রাখা হয়।
এসময় ক্যাম্পে তাদের ওপর নির্মমভাবে অত্যাচার ও নির্যাতন করে সামরিক বাহিনী। ওই সময়ে দায়িত্বরত রাজশাহী ক্যান্টনমেন্টের সেকেন্ড ইন কমান্ড জিয়াউর রহমান নিজে মেজর হাফিজকে সঙ্গে নিয়ে বন্দিদের দেখতে আসে। তারা ওই বন্দিদের মধ্যে এরাদ আলী, মন্টু মাস্টারসহ রশিদের সঙ্গে প্রায় ঘণ্টাব্যাপী রুদ্ধদার আলাপ করেন। শেষে বন্দিদের মধ্যে মাত্র ৪ জনকে কারাগারে পাঠিয়ে ১১ ডিসেম্বর রাজশাহী জেলার তানোর থানার গোল্লাপাড়া বাজারের গোডাউনের পার্শ্বে বিল্পবী ৪৪ জন নেতাকর্মীকে অমানবিক নির্মম নির্যাতনে হত্যা করে গণকবর দেয়। এই বিরল মর্মান্তিক লোমহর্ষক ঘটনার মাইল ফলক হিসেবে আজ ১১ ডিসেম্বর তানোর দিবস হিসেবে ইতিহাসের পাতায় কালো অধ্যায় হয়ে থাকে।
পরে ওই শহীদদের স্মৃতি অমর করে রাখতে তানোর থানার গোল্লাপাড়া বাজারের গুদামের পাশে স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়। তাদের স্মৃতি চারণে দলের নেতাকর্মী ও স্বজনরা ১১ ডিসেম্বর পুষ্পস্তবক অর্পণ ও শহীদদের আত্মার শান্তি কামনার জন্য হাজির হন।
তবে স্থানীয়দের অভিযোগ, প্রতিবছরই ১১ ডিসেম্বর আসলে ওই স্মৃতিস্তম্ভটি পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতার মাধ্যমে স্মৃতিচারণ করার মানসে বর্ণিল সাজে। আর বছরের বাকি মাসগুলো ওই স্থানটি পরিণত হয় গরু-ছাগলের বিচরণ ভূমিতে। সেই সঙ্গে লোকজন খোলা জায়গা হিসেবে এখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা আর প্রাকৃতিক কার্যাদি সম্পন্ন করে।
তারা আরও জানান, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পালাবদলের রাজনীতির স্রোতধারায় একে একে প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার রাজনৈতিক সরকার হয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। কিন্তু হতভাগ্য সেই প্রগতিশীল কৃষক আন্দোলনের ৪৪ নেতাকর্মীর গণকবরের স্থানটি রক্ষণাবেক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। রাষ্ট্রীয়ভাবে দিবসটি উদযাপনের জন্য কোনো উদ্যোগ আজও নেয়া হয়নি।