নিজস্ব প্রতিবেদক :লিকুফাইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস বা এলপিজি খাত অসুস্থ প্রতিযোগিতার মুখে পড়ে অরাজক পরিস্থিতির সৃষ্টি হচ্ছে। অথচ বিকল্প জ্বালানি হিসেবে এলপিজি দেশে একটি বিকাশমান খাত। কিন্তু উৎপাদন পর্যায়ে মূসক আরোপ, ট্যারিফ ভ্যাট প্রত্যাহার, স্টোরেজ ক্যাপাসিটি বৃদ্ধিসহ নতুন নীতিমালায় বেশকিছু কঠিন শর্ত আরোপের কারণে এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। নতুন নীতিমালায় গুটিকয়েক বড় কোম্পানি লাভবান হলেও হুমকির মুখে পড়েছে মাঝারি পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের শত শত কোটি টাকার বিনিয়োগ। এলপিজি খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, এদেশে ’৮০-র দশক থেকে বোতলজাত বা সিলিন্ডার গ্যাসের বাজারজাত শুরু হয়। ’৯০-র দশক থেকে এর চাহিদা বাড়তে থাকে। বর্তমানে শতভাগ আমদানিনির্ভর এই গ্যাসের চাহিদা বছরে ১২ লাখ মেট্রিক টন। আর চাহিদা দিন দিন বেড়েই চলেছে। বর্তমানে দেশে মুদি দোকান, ফার্মেসি থেকে শুরু করে পথে পথে বিক্রি হচ্ছে এলপিজি ভর্তি সিলিন্ডার। আর একই গ্যাস একেক কোম্পানি ইচ্ছামতো একেক দামে বিক্রি করছে। তাতে ঠকছে ভোক্তারা। এমন অরাজক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ ও এ খাতকে চাঙ্গা করতে ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটির কমিশনের কাছে নীতিমালা সংশোধনসহ ৭ দফা প্রস্তাব করেছে। ব্যবসায়ীরা ওসব প্রস্তাব পেশ করে তা কার্যকরের অনুরোধ জানিয়েছে।
সূত্র জানায়, ব্যবসাবান্ধব নীতির আলোকে বোতলজাত এই গ্যাসের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করার জন্য বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয় ৫৭টি প্রতিষ্ঠানকে লাইসেন্স প্রদান করেছে। তার মধ্যে এ খাতে ১৫ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছে ২৯টি প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি লক্ষাধিক লোকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। তাছাড়া উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট অব্যাহতি থাকার কারণে এলপিজি বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যাকওয়ার্ড লিংকেজ বা পশ্চাতসংযোগ শিল্প হিসেবে সিলিন্ডার উৎপাদনের জন্য ২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে অন্তত ১৪টি কারখানা গড়ে উঠেছে। দেশে সিলিন্ডার উৎপাদন শুরু হওয়ায় একদিকে যেমন আমদানি নির্ভরতা কমে এসেছে, অন্যদিকে সাশ্রয় হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রা। কিন্তু ২০২০-২০২১ অর্থবছরে এ খাতে সিলিন্ডার উৎপাদন পর্যায়ে ১৫ শতাংশ হারে মূসক আরোপ করা হয় এবং আমদানি পর্যায়ে একই হারে কমানো হয়। ফলে দেশে উৎপাদিত সিলিন্ডারের মূল্য আমদানিকৃত সিলিন্ডারের চেয়ে বেশি পড়ছে। তাতে দেশে গড়ে ওঠা নতুন কারখানাগুলো অস্তিত্ব সংকটে পড়তে শুরু করেছে।
সূত্র আরো জানায়, এলপি গ্যাসে ইফনিটপ্রতি ৯ টাকা (১২ কেজি) ট্যারিফ ভ্যাট প্রচলিত থাকলেও গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে তা উঠিয়ে বিক্রয়মূল্যের ওপর ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ করা হয়। তাতে ভ্যাটের পরিমাণ এক লাফে ৯ টাকা থেকে ৪-৫ গুণ বেড়ে যায়। অর্থাৎ আগে প্রতি সিলিন্ডার গ্যাসের ওপর ৮ থেকে ১২ টাকা পর্যন্ত ট্যারিফ নির্ধারিত ছিল। বিক্রয় মূল্যের ওপর ৫ শতাংশ ট্যারিফ নির্ধারণ করায় প্রতিটি সিলিন্ডার গ্যাসের দাম ৩৫ থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত বেড়ে যায়। আর আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর সিলিন্ডার গ্যাসের দামও ওঠানামা করে। দেশে এলপি গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে বাজারজাতকারী প্রতিষ্ঠানগুলো তা সমন্বয় করতে হিমশিম খাওয়ার পাশাপাশি বিপুল আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ছে। এ খাতের ব্যবসায়ীদর অভিযোগ, দুঃখজনক হচ্ছে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা না করেই সরকার ২০১৭ সালে এলপি গ্যাস অপারেশনাল ও লাইসেন্সিং নীতিমালা প্রণয়ন করেছে। তাতে বাস্ততাবিবর্জিত কিছু কঠিন শর্ত জুড়ে দেয়া হয়। একেকটি প্ল্যান্টে মজুদ ক্ষমতা ৫ হাজার টনে বৃদ্ধি করা ও পরিবহনের ক্ষেত্রে নিজস্ব জলযান ব্যবহারের শর্ত জুড়ে দেয়া হয়। দেশের কেবল ৫-৭টি প্রতিষ্ঠানেরই ৫ হাজার টন স্টোরেজ ক্ষমতা রয়েছে এবং তারে নিজস্ব জলযানও রয়েছে। বাকি অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানেরই তা নেই। ওসব প্রতিষ্ঠানের বড়জোর ২০০ টন থেকে ২ হাজার টন স্টোরেজ ক্ষমতা রয়েছে। মূলত সবল প্রতিষ্ঠানের লাভের জন্যই বিপুল পরিমাণ স্টোরেজ ক্ষমতার শর্ত জুড়ে দেয়া হয়েছে। যার প্রেক্ষিতে এ খাতের ভুক্তভোগী ও ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীরা ওই দুই শর্তের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে রিট করে এবং উচ্চ আদালত স্থগিতাদেশ প্রদান করেন।
এদিকে ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশ থাকার পরও এলপি গ্যাস মজুদ ক্ষমতা ৫ হাজার টনে বৃদ্ধি করতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে বারবার চিঠি দিয়ে বাধ্য করা হচ্ছে। আর তা করতে গিয়ে চাহিদার তুলনায় একদিকে অতিরিক্ত বিনিয়োগ করতে হচ্ছে; কিন্তু সে অনুযায়ী ব্যবসা হচ্ছে না। ফলে এলপিজি খাতের অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানই মুখ থুবড়ে পড়ছে। ব্যাংক ঋণ নিয়ে যেসব প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করছে সেসব প্রতিষ্ঠান এখন দেউলিয়া হওয়ার পথে।
অন্যদিকে এলপিজি বিক্রির জন্য পরিবেশককে বিস্ফোরক অধিদফতরের লাইসেন্স নিতে হতো। নতুন নীতিমালয়া তা শিথিল করা হয়েছে। ফলে যত্রতত্র এলপিজি সিলিন্ডার বিক্রি হচ্ছে। যে কারণে এলপিজির বাজারমূল্য নিয়ন্ত্রণ করাও দুষ্কর হয়ে পড়ছে। বর্তমান বাজারে প্রচলিত ১২ কেজি ওজনের প্রতি সিলিন্ডার গ্যাসের দাম ৭০০ থেকে ৭৩০ টাকা। তবে আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর এই দাম কমবেশি হয়ে থাকে। দেশে এলপিজি খাতের এমন অরাজকতা বন্ধে ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা ৭টি প্রস্তাব করেছে। প্রস্তাবগুলো হলো- এলপিজির লাইসেন্স প্রণয়ন, নবায়ন, তদারকিসহ সব বিষয় নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা বাংলাদেশ রেগুলেটরি কমিশন ও বিস্ফোরক পরিদফতরের ওপর ন্যস্ত করা। এলপিজি সিলিন্ডার বিক্রয়, বিপণন ও হস্তান্তরে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার জন্য বিস্ফোরক অধিদফতরের আঞ্চলিক অফিসগুলোর ক্ষমতা বৃদ্ধি। খুচরা গ্যাস বিক্রির ওপর আরোপিত ৫ শতাংশ মূসক রদ। সিলিন্ডার বিক্রির ওপর নতুন করে আরোপিত ১৫ শতাংশ মূসক সম্পূর্ণ প্রত্যাহার। সংশ্লিষ্ট দফতরগুলোর প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গ্যাসের মূল্য নির্ধারণে বিশেষ কমিটি গঠন ও বাস্তবসম্মত যুগোপযোগী নীতিমালা প্রণয়ন করা। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটির কমিশন (বিইআরসি) ও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম কর্পোরেশনের (বিপিসি) অতি উচ্চমূল্যে লাইসেন্স ফি হ্রাস করা।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক পরিচালক ও বোতলজাত গ্যাস ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ব্যবসায়ী মাহফুজুল হক শাহ জানান, ব্যবসায়ীরা বিকাশমান ও সম্ভাবনাময় এলপিজি শিল্পের জন্য একটি বৈষম্যহীন সুষ্ঠু নীতিমালা চাই। গুটিকয়েক ব্যবসায়ী যাতে এই ব্যবসার একক নিয়ন্ত্রণ নিতে না পারে, ভোক্তারা যাতে দুর্বল ও বৈষম্যমূলক নীতিমালার বলি না হয়, এ ব্যবসায় শুরু থেকেই যারা বিনিয়োগ করেছেন তাদের বিনিয়োগ যাতে হুমকিতে না পড়ে- সে বিষয়ে জ্বালানি মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিটি ও এফবিসিসিআইর ৃষ্টি আকর্ষণ করে সম্প্রতি চিঠি পাঠানো হয়েছে। চিঠিতে বেশকিছু প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। আশা করা যায় প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন হলে বৃহৎ এই খাত নিয়ে অরাজকতার কোনো সুযোগ থাকবে না।