নিজস্ব প্রতিবেদক : কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না সরকারি কেনাকাটায় দুর্নীতি। বরং সুযোগ পেলেই সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, দফতর, অধিদফতরের পণ্য কেনাকাটায় সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা অস্বাভাবিক হারে দুর্নীতি করছে। সেক্ষেত্রে ওসব সরকারি কর্মকর্তারা কোনো রকম নিয়ম না মেনে কিংবা নিয়মের ফাঁকফোকর গলিয়ে নিজেদের পছন্দের ঠিকাদারদের দিয়ে বাজার মূল্যের চেয়ে উচ্চ মূল্যে পণ্য কেনাকাটা করে নিজেরা মোটা টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। তাতে সরকারের বড় অংকের আর্থিক লোকসান হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে অনেক দফতরের কেনাকাটা নিয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) কর্তৃক তথ্য প্রমাণ পাওয়া এবং কেনাকাটায় সম্পৃক্ত একাধিক কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করার পরও কেনাকাটায় দুর্নীতি থামনো যাচ্ছে না। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সরকারের স্বাস্থ্য, উন্নয়ন খাত, পূর্ত, রেলওয়ে, বিমান, সিভিল এভিয়েশন, শিক্ষা খাত, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল বিভাগ, সেবা খাতসহ সরকারি প্রায় সব মন্ত্রণালয়, দফতর, অধিদফতর সব জায়গাতেই কেনাকাটায় কমবেশি দুর্নীতি ঘটনা ঘটছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও দফতরগুলোর নিজস্ব তদন্তেও ওসব দুর্নীতির সত্যতা পাওয়া যাচ্ছে। দুদকও তদন্ত করছে। সর্বশেষ করোনাকালে বাংলাদেশ রেলওয়ের সুরক্ষা সরঞ্জাম কেনাকাটা নিয়ে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের একটি তদন্তে আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতির সংশ্লিষ্টতার তথ্য বেরিয়ে এসেছে। সেজন্য রেলওয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ২৯ কর্মকর্তাকে দায়ী করা হয়েছে।
সূত্র জানায়, সরকারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তাদের মতে, কেনাকাটার সঙ্গে যুক্ত সর্বোচ্চ কর্মকর্তা যদি নিজে দুর্নীতিগ্রস্ত হন তাহলে কেনাকাটায় দুর্নীতি থামানো কঠিন। সরকারি কেনাকাটার ব্যাপারে পাবলিক প্রকিউরমেন্ট আইন (পিপিআর) ও বিধিমালা রয়েছে। তা অনুসরণ করলে কোনোভাবেই দুর্নীতি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু কেনাকাটার সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা তা যথাযথভাবে অনুসরণ না করে বরং তারা কীভাবে আর্থিক অনিয়ম ও দুর্নীতি করা যায় সেদিকটি বেশি খুঁজতে থাকে। মূলত সরকারি কেনাকাটায় দুর্নীতি বন্ধ না হওয়ার মূল কারণ হচ্ছে পিপিআর অনুসরণ না করা। দরপত্রের ক্ষেত্রে ই-জিপি চালু করলেও সেখানে দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া হয়। যে কারণে কেনাকাটায় দুর্নীতি বন্ধ করা যাচ্ছে না।
সূত্র আরো জানায়, সরকারি কেনাকাটা আইন কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করা জরুরি। যারা পিপিআর ভঙ্গ করে তাদের কঠিন শাস্তির আওতায় আনতে। সরকারি কেনাকাটায় দুর্নীতি বন্ধে আইনের কঠোর প্রয়োগ ছাড়া কোনো বিকল্প নেই। সরকার অনেক প্রত্যাশা নিয়ে ই-জিপির প্রবর্তন করলেও সরকারি কেনাকাটায় দুর্নীতি কমেনি এবং সেক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হয়নি। সরকারি কেনাকাটায় দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধ এবং স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে সরকার পাবলিক প্রকিউরমেন্ট বিধিমালা (পিপিআর) তৈরি করেছে। তা অনুসরণ করেই কেনাকাটা করার কথা। কিন্তু বাস্তবে সরকারের কোনো কোনো মন্ত্রণালয়, দফতর বা সংস্থা কেনাকাটার ক্ষেত্রে পিপিআর অনুসরণ করে না। বরং কেনাকাটার সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা নিজেদের পছন্দের ও ঘনিষ্ঠ ঠিকাদারদের দিয়ে কেনাকাটা করায়। যাতে উভয়পক্ষ আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারে। আর জরুরি ভিত্তিতে তাৎক্ষণিক কেনাকাটা হলে তো পোয়াবারো অবস্থা। কারণ ওই সময়ে কোনো রকম দরপত্র আহ্বান করতে হয় না। নিজেদের লোকজনদের দিয়েই কেনাকাটা করানো হয়। তাতে দুর্নীতি করা আরো সহজ হয়।
এদিকে করোনাকালে সুরক্ষা সামগ্রী কেনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ রেলওয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা মাস্ক, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, থার্মোমিটার, জীবাণুনাশক টানেল, সাবান, অক্সিজেন সিলিন্ডারসহ এ ধরনের সামগ্রী তাৎক্ষণিক কিনতে গিয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু ঠিকাদারকে দায়িত্ব দেয়, যারা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ঘনিষ্ঠ। তাতে ঠিকাদারদের সঙ্গে যোগসাজশ করে কেনাকাটার সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা ৮ টাকার গ্লাভস ৩২ টাকায়, ১৩০ টাকার হ্যান্ড স্যানিটাইজার ৩৮৪ টাকায়, ১২০ টাকা থেকে ১৫০ টাকায় প্লাস্টিকের চশমা প্রতিটি ৩৯৭ টাকায় কিনেছে। এভাবেই তারা প্রত্যেকটি জিনিস বাজার মূল্যের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দাম দিয়ে কিনেছে। বিষয়টি জানাজানির পর রেলপথ মন্ত্রণালয় তদন্ত কমিটি গঠন করে একজন যুগ্ম-সচিবের নেতৃত্বে। ওই কমিটি কেনাকাটায় দুর্নীতির সত্যতা পেয়েছে। একই সঙ্গে কমিটি তাদের প্রতিবেদনে কেনাকাটার সঙ্গে যুক্ত রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (রোলিং স্টক) ও কেন্দ্রীয় সরঞ্জাম কর্তৃপক্ষের প্রধানসহ ২৯ কর্মকর্তাকে দায়ী করে ভবিষ্যতে তাদের এ ধরনের কেনাকাটায় সম্পৃক্ত না করার সুপারিশ করেছে।
অন্যদিকে শুধু রেলওয়ে নয়, তার আগে গত বছর রূপপুর প্রকল্পের বালিশ কেলেঙ্কারির ঘটনাও ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসে। সেখানে একটি বালিশের পেছনে ব্যয় দেখানো হয়েছে ৬ হাজার ৭১৭ টাকা। তার মধ্যে বালিশের দাম ৫ হাজার ৯৫৭ টাকা, আর আর সেই বালিশ ফ্ল্যাটে উঠানোর খরচ ৭৬০ টাকা দেখানো হয়। বিষয়টি গুমাধ্যমে প্রকাশিত হওয়ার পর গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয় দুটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। দুই কমিটির তদন্তেই ৬২ কোটি ২০ লাখ ৮৯ হাজার টাকার অনিয়মের কথা উঠে আসে। হাইকোর্টের নির্দেশে আদালতে জমা দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনে দুর্নীতির জন্য ৩৪ জন প্রকৌশলীকে দায়ী করা হয়। দুদকও ওই ঘটনা অনুসন্ধান করে। দুদকের অভিযোগে বলা হয়, পাবনা গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী ও অন্যদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে পাবনার রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্পের আসবাবপত্র ও অন্যান্য সামগ্রী অস্বাভাবিক দামে কিনে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ পাওয়া গেছে। গত বছর ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পর্দা কেনাকাটায়ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। একটি পর্দা কিনতে ৩৭ লাখ টাকা ব্যয় করা হয়। একই সঙ্গে মেডিকেলের যন্ত্রপাতি কেনাকাটায়ও দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। আলোচিত ওই পর্দা কেলেঙ্কারি ও যন্ত্রপাতি কেনার ঘটনায় ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল স্থাপন প্রকল্পের সাবেক দুই প্রকল্প পরিচালককে গত ৯ সেপ্টেম্বর বরখাস্ত করা হয়। শুধু তাই নয়, পর্দা ও যন্ত্রপাতি কেনায় ১০ কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগ এনে দুদক গতবছর ২৭ নভেম্বর মামলাও করে।