নিজস্ব প্রতিবেদক ; বৈদেশিক মুদ্রার সরবরাহ করোনাকালে ব্যাপকভাবে বেড়েছে। ফলে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে ব্যাংকগুলো উদ্বৃত্ত প্রচুর ডলার বিক্রি করছে। ফলে চাহিদার তুলনায় বাজারে ডলারের সরবরাহ বেড়ে গেছে। এমন অবস্থায় বাংলাদেশ ব্যাংক টাকার দরপতন ঠেকাতে বাজার থেকে প্রচুর ডলার কিনছে। শুধু জুলাই থেকে গত সপ্তাহ পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ৪২০ কোটি ডলার কেনা হয়েছে। আর চলতি বছরের শুরু থেকে ডলার কেনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৫০৮ কোটি ডলার। অথচ তার আগের তিন বছরে ব্যাপক চাহিদার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার নিয়মিত বিক্রি করেছে। আর বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মিত ডলার কেনার কারণে আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে গত বছরের মতো ডলারের দর ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় অপরিবর্তিত রয়েছে। অবশ্য গত জুন মাসের দিকে আন্তঃব্যাংকে সর্বোচ্চ ৮৪ টাকা ৯৫ পয়সা দরে ডলার বিক্রি হয়েছিল। ব্যাংকিং খাত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়। সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশে কর্মরত বাণিজ্যিক ব্যাংকের কাছে ডলার উদ্বৃত্ত থাকলে বাংলাদেশ ব্যাংক তা কিনে নেয়। কারণ প্রতিটি ব্যাংকের ডলার ধারণের একটি সীমা রয়েছে। কোনো ব্যাংকের আমদানির দায় পরিশোধের তুলনায় প্রবাসী রেমিট্যান্স ও রফতানি আয় বেশি হলে ওই ব্যাংকে ডলার উদ্বৃত্ত হয়। সেক্ষেত্রে উদ্বৃত্ত থাকা ব্যাংক প্রথমে সংকটে থাকা ব্যাংকের কাছে বিক্রির চেষ্টা করে। তখন কোনো ব্যাংকের আগ্রহ না থাকলে অর্থাৎ মুদ্রাবাজারে বিক্রি করতে না পারলে স্বাভাবিকভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক তা কিনে নেয়।
সূত্র জানায়, করোনা ভাইরাস মহামারির শুরুর দিকে ধস নামলেও পরে ঘুরে দাঁড়িয়েছে দেশের রফতানি। একই সাথে কমে যাওয়ার আশঙ্কার বদলে দেশে ব্যাপকভাবে বেড়েছে রেমিট্যান্সের পরিমাণ। পাশাপাশি আগের সময়ের চেয়ে আমদানিও কমেছে। গত অক্টোবর পর্যন্ত চার মাসে রেমিট্যান্স বেড়েছে ৪৩ দশমিক ২৫ শতাংশ। আর রফতানিতে এক শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি রয়েছে। তাছাড়া সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আমদানি কমেছে ১১ দশমিক ৪৩ শতাংশ। এ সময়ে বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, এডিবিসহ বিভিন্ন সংস্থা থেকেও প্রচুর ঋণও এসেছে। আবার বেসরকারি খাতে নেয়া স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানোর কারণেও অনেকে আপাতত ঋণ পরিশোধ করছে না। সব মিলে অধিকাংশ ব্যাংকের হাতে এখন ডলার উদ্বৃত্ত রয়েছে। অথচ করোনার প্রভাব শুরুর আগ পর্যন্ত সরবরাহের তুলনায় চাহিদা বেশি থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংক ধারাবাহিকভাবে ডলার বিক্রি করছিল। তখন প্রায়ই সরকারি মালিকানার কয়েকটি ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে ডলার কিনতে ধরনা দিচ্ছিল। তবে চলতি বছরের শুরু থেকে পরিস্থিতি উল্টো হয়ে যায়। জানুয়ারি থেকে গত সপ্তাহ পর্যন্ত বিভিন্ন ব্যাংক থেকে ৫০৮ কোটি ডলার কিনে বাজারে ৪৩ হাজার কোটি টাকার বেশি সরবরাহ করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। বিপরীতে বাংলাশে এ সময় মাত্র ৪২ কোটি ৮০ লাখ ডলার বিক্রি করে। তাছাড়া চলতি বছরের জুন পর্যন্ত প্রথম দুই প্রান্তিকে বিভিন্ন ব্যাংকের কাছ থেকে ৮৭ কোটি ৭০ লাখ ডলার কেনা হয়। তারপর থেকে কোনো ব্যাংক ডলার কেনার জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকে আসেনি। অথচ ২০১৯ সালের চিত্রটা ছিল ঠিক তার বিপরীত। গত বছর বিভিন্ন ব্যাংক বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ১৬২ কোটি ১০ লাখ ডলার কিনেছিল। তার আগের বছর ব্যাংকগুলো ২৩৭ কোটি ১০ লাখ এবং ২০১৭ সালে ১২৩ কোটি ১০ লাখ ডলার কেনে। ওই তিন বছরের মধ্যে শুধুমাত্র ২০১৭ সালের শুরুর দিকে কয়েকটি ব্যাংক সাড়ে ৪ কোটি ডলার কিনেছিল।
সূত্র আরো জানায়, বাংলাদেশ ব্যাংক বাজার থেকে ডলার কিনলে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ে। ডলার বিক্রি করলে রিজার্ভ কমে। কয়েক মাস আগেও প্রচুর ডলার বিক্রির ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দীর্ঘদিন ধরে ৩১ থেকে ৩৩ বিলিয়ন ডলারের ঘরে ওঠানামা করছিল। বাংলাদেশে করোনার প্রভাব শুরুর পর গত মার্চ শেষে যেখানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩২ দশমিক ৩৯ বিলিয়ন ডলার, গত কয়েক মাসে তা বেড়ে ৪১ বিলিয়ন ডলারের ঘর অতিক্রম করে। সম্প্রতি এশিয়ান কিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) দায় পরিশোধের পরও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৪০ বিলিয়ন ডলারের ওপরে রয়েছে। তার আগে ২০১১-১২ অর্থবছর শেষে যেখানে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ছিল মাত্র ১০ দশমিক ৩৬ বিলিয়ন ডলার। মাত্র ৫ বছরে তা ৩ গুণ বেড়ে ২০১৫-১৬ অর্থবছর শেষে ৩০ দশমিক ১৭ বিলিয়ন ডলারে উঠেছিল। অবশ্য তারপর রিজার্ভ আর সেভাবে বাড়েনি।
এদিকে এ প্রসঙ্গে পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ হালিম চৌধুরী জানান, রেমিট্যান্সে সরকারের ২ শতাংশ হারে প্রণোদনায় হুন্ডি প্রবণতা কমার কারণে প্রবাসী আয় ব্যাপকভাবে বাড়ছে। আবার বিদেশ থেকে মানুষের আসার পরিমাণ কমে যাওয়ায় আগে সবাই নিজেরা যে ডলার আনতেন তা কমে গেছে। ওই ডলারও এখন ব্যাংকিং চ্যানেলে আসছে। ওসব কারণে রেমিট্যান্স উল্লেখযোগ্য হারে বাড়ছে। আবার এ সময়ে রফতানিতে কিছুটা হলেও প্রবৃদ্ধি রয়েছে। তবে আমদানি কমছে। এ অবস্থায় ডলার নিয়ে ব্যাংকগুলো খুব স্বস্তিদায়ক অবস্থানে আছে।