নাটোরের দুই চিনিকলে ১০০ কোটি টাকার চিনি অবিক্রিত

নাটোরের দুই চিনিকলে ১০০ কোটি টাকার চিনি অবিক্রিত
নাটোর: নাটোরের নর্থ বেঙ্গল সুগার মিল ও নাটোর সুগার মিলে উৎপাদিত ১৬ হাজার ১০০ মেট্রিক টন চিনি এখনো বিক্রি হয়নি। অবিক্রিত এ চিনির মূল্য প্রায় ১০০ কোটি টাকা।
এছাড়া গত এপ্রিল মাস থেকে বেতন ভাতা না পেয়ে এ দুই সুগার মিলের কয়েকশ’ কর্মকর্তা-কর্মচারীও মানবেতর জীবনযাপন করছেন। এমনকি কোনো কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী অবসরে গেলেও তাকে প্রাপ্য টাকার পরিবর্তে চিনি নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
তবে মিল কর্তৃপক্ষ বলছে, চিনি বিক্রি না হওয়ায় তাদের পর্যাপ্ত পরিমাণ চিনি মজুদ রয়েছে। ফলে সময়মতো চিনি বিক্রি করতে না পারায় একদিকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন দেওয়া যাচ্ছে না। অপরদিকে আখ চাষিদের পাওনা টাকাও পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।
এ পরিস্থিতিতে কৃষকরা আখ চাষে আগ্রহ হারিয়ে ফেলবেন। এতে আসন্ন ২০২০-২১ মৌসুমে প্রয়োজনীয় আখ সংকটের শঙ্কা দেখা দেবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ফলে আগামীতে চিনি উৎপাদনও বাধাগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সরকারিভাবে এ বিষয়ে দ্রুত ব্যবস্থা না নিলে সংকট আরো ঘনীভূত হবে।  এদিকে বকেয়া টাকা আদায়ে চিনিকল কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করতে আন্দোলনে নেমেছেন নাটোর সুগার মিলের আখ সরবরাহকারী চাষিরা। সম্প্রতি নাটোর সুগার মিলের সাব জোন অফিসগুলোতে সদর, আহমেদপুর, নলডাঙ্গা, দত্তপাড়া, বাসুদেবপুরসহ বিভিন্ন এলাকার আখচাষিরা বিক্ষোভের পর তালা ঝুলিয়ে দিয়েছেন।
একই সঙ্গে তারা গত ৯ সেপ্টেম্বরের মধ্যে বকেয়া টাকা পরিশোধের জন্য আল্টিমেটাম দিয়েছিলেন। ওই সময়ের মধ্যে টাকা না পেলে মিলের মহাব্যবস্থাপকের অফিস কক্ষসহ নাটোর সুগারমিলেও তালা ঝুলিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন তারা। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হয়নি আখ চাষিদের।
অপরদিকে, আন্দোলনে না নামলেও পাওনা টাকা না পেয়ে ক্ষোভে ফুঁসে উঠছে নর্থ বেঙ্গল সুগারমিলের অঙ্গীকারবদ্ধ আখ চাষিরাও। জানা যায়, দেশের ১৭টি সুগার মিলের মধ্যে নাটোর সুগার মিল ও নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলের বার্ষিক উৎপাদন ক্ষমতা ৩০ হাজার মেট্রিক টন। একক জেলা থেকে উৎপাদিত আখ মাড়াইয়ের পর চিনি উৎপাদনে নাটোর রয়েছে শীর্ষস্থানে। তবে সময় মত চিনি বিক্রি করতে না পারায় বেকায়দায় রয়েছে এ দু’টি সুগার মিলের কর্তৃপক্ষ।
নাটোর সুগার মিল ও নর্থ বেঙ্গল সুগার মিল সূত্র জানায়, চলতি মৌসুমে নাটোর সুগার মিলে প্রায় ৫০ কোটি টাকা মূল্যের আট হাজার ৫০০ মেট্রিক টন চিনি মজুদ রয়েছে। আর লালপুরের নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলে মজুদ রয়েছে প্রায় ৪৫ কোটি টাকা মূল্যের সাত হাজার ৬০০ মেট্রিক টন চিনি। সব চিনি বর্তমানে অবিক্রিত অবস্থায় মজুদ রয়েছে।
তবে উৎপাদিত কিছু পরিমাণ চিনি বিক্রির পর চাষিদের আখের দাম পরিশোধ করা হয়েছে। এতে চলতি করোনা সংকটে বড় ধরনের ধাক্কাও খেয়েছে মিল দু’টি। দেশের আমদানি-রফতানি ও সার্বিক ব্যবসা বাণিজ্যে স্থবিরতা আসায় গত পাঁচ মাস উল্লেখযোগ্য পরিমাণ চিনি বিক্রি করতে পারেনি এ দু’টি মিল। এছাড়া বরাদ্দ ট্রেড গ্যাপ মানিও মঞ্জুর করেনি করপোরেশন। ফলে শোধ হয়নি আখের দামও।আখচাষি মো. আলাউদ্দীন ও আব্দুল গণি জানান, আখ বিক্রির একটি টাকাও না পেয়ে গত পাঁচ মাস ধরে তারা নিদারুণ কষ্টে জীবনযাপন করছেন তারা। ধার-দেনা করে সংসার চালাতে চালাতে এখন আর ধারকর্জও করতে পারছেন না।  তিতুমীর আলী বাদশা ও আমির হোসেন নামে দুই আখচাষি বলেন, মিল কর্তৃপক্ষের টাকা পরিশোধের কোনো উদ্যোগ নেই। আমরা নিরুপায় হয়ে অফিসে তালা দিতে বাধ্য হয়েছি। নাটোর সুগার মিলের বাগাতিপাড়া সাব জোনের আখচাষি নেতা আশরাফুল আলম খান বাংলানিউজকে বলেন, চলতি বছরের ২১ মার্চ পর্যন্ত চাষিরা এ সাব জোনের অধীনে আটটি ক্রয় কেন্দ্রে আখ সরবরাহ করেছেন। এজন্য সুগার মিলের কাছে প্রায় এক হাজার আখচাষির বকেয়া রয়েছে প্রায় তিন কোটি টাকা। বারবার এ টাকা আদায়ে তাগাদা দিয়েও কোনো কাজ হয়নি। সবশেষ চিনিকল কর্তৃপক্ষ সেপ্টেম্বরের ১ তারিখ টাকা পরিশোধের অঙ্গীকার করেছিলেন। নির্ধারিত দিন পার হলেও এখনো টাকা পরিশোধের কোনো লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।
নাটোর সুগার মিলের সিবিএ সভাপতি ফিরোজ আলী বাংলানিউজকে বলেন, গত এপ্রিল মাস থেকে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বন্ধ রয়েছে। এমনকি কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী অবসরে গেলেও তাকে প্রাপ্য টাকার পরিবর্তে চিনি নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে, যা খুবই অমানবিক। এসব চিনি বিক্রি করতে গেলে বাজারমূল্যের চেয়েও কম দাম পেতে হয়।  বাংলাদেশ জাতীয় কৃষক সমিতির জেলা সাধারণ সম্পাদক আব্দুল করিম বলেন, চাষিদের শ্রমের মূল্য বকেয়া রাখা অমানবিক। এক মৌসুমের টাকায় চাষিরা পরের মৌসুমে আখ চাষের প্রস্ততি নেন। কিন্ত এবার দীর্ঘ সময় টাকা বকেয়া থাকায় সার্বিক আখ চাষ ও চিনি উৎপাদনে বিরূপ প্রভাব পড়বে। চাষিরা সুগার মিলে আখ সরবরাহ না করলে সুযোগ নেবে নিষিদ্ধ পাওয়ার ক্রাশারে আখ মাড়াইকারী ও বেসরকারি চিনি উৎপাদনকারীরা। চিনির দাম বাড়িয়ে ভোক্তাদের জিম্মি করার আগেই সরকারকে এ ব্যাপারে তড়িৎ পদক্ষেপ নিতে হবে। নাটোর সুগার মিলের মহাব্যবস্থাপক মো. রফিকুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, করোনা পরিস্থিতির কারণে চিনি আমদানি-রফতানি, এমনকি অভ্যন্তরীণ বাজারে বিক্রি কার্যক্রম স্থবির হয়ে পড়েছে। এছাড়া বেসরকারি মিলের চিনির দাম বাজারে কম। এ কারণে আমাদের চিনি কাঙ্ক্ষিত পরিমাণে বিক্রি হয়নি। তবে করপোরেশনের ট্রেড গ্যাপ অর্থ প্রাপ্তি সাপেক্ষে আগে চাষিদের বকেয়া টাকা ও চিনিকলের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বকেয়া বেতন পরিশোধ করা হবে।  অপরদিকে, লালপুর নর্থ বেঙ্গল সুগার মিলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. হুমায়ুন কবীরও করোনাজনিত বিক্রি হ্রাসের সত্যতা স্বীকার করে বাংলানিউজকে বলেন, বর্তমানে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হওয়ায় স্বল্প পরিসরে চিনি বিক্রি শুরু হয়েছে। এতে একটু দেরিতে হলেও চাষিদের পাওনা পরিশোধ করা হবে। আর ট্রেড গ্যাপ মানি মঞ্জুর হলে চাষিদের বকেয়া পাওনা দ্রুত পরিশোধ করা সম্ভব হবে।

Leave a reply

Minimum length: 20 characters :: 99 characters remaining

More News...

বীরগঞ্জে শিশু সন্তানকে নিয়ে ‘গ্যাস ট্যাবলেট’ খেয়ে মা-মেয়ের মৃত্যু

দালালমুক্তসহ মাদক নিয়ন্ত্রণে সক্রিয় ভূমিকা পালন করায় বিপাকে রাজৈর থানার ওসি