দিনাজপুর: দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ওয়াহিদা খানম ও তার বাবা মুক্তিযোদ্ধা ওমর আলী শেখের ওপর হামলার ঘটনায় আটক রবিউল ইসলাম কোনোভাবেই জড়িত নয় বলে দাবি করেছে তার পরিবার। এমনকি হামলার সময় ও পরেরদিন রবিউল বাড়িতেই ছিলেন বলে দাবি করেছেন তার বড় ভাই শফিকুল ইসলাম।
অপরদিকে, পর্যাপ্ত প্রমাণ ও সিসিটিভি ফুটেজের সঙ্গে মিল রেখে রবিউলকে আটক করা হয়েছে বলে দাবি করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা।
জানা যায়, ২০০৮ সালে অষ্টম শ্রেণির সনদ দিয়ে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের চাকরিতে যোগদান করেছিল দিনাজপুরের বিরল উপজেলার বিজোড়া ইউনিয়নের ভীমপুর গ্রামের মৃত. খতিব উদ্দীনের ছেলে রবিউল ইসলাম। পদোন্নতির জন্য পড়াশোনা করে এইচএসসি পাস করেন এবং উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ডিগ্রি পরীক্ষাও দিয়েছিল। গ্রেফতার হওয়া রবিউল ইসলামরা সাত ভাই। এরমধ্যে তিনি সপ্তম। ভাইদের মধ্যে পাঁচজনই সরকারি কর্মচারী। তার তিন ভাই দিনাজপুর পৌরসভায় চাকরি করেন আর আরেক ভাই চাকরি করেন জেলা প্রশাসকের অধীনস্থ সার্কিট হাউসে। গত ৯ সেপ্টেম্বর রাত ১টা ১০ মিনিটে তাকে বাড়ি থেকে আটক করে ডিবি পুলিশ।
শনিবার (১২ সেপ্টেম্বর) বিকেল সাড়ে ৩টায় দিনাজপুরের পুলিশ সুপার (এসপি) কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ পুলিশ রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য জানান, গত ২ সেপ্টেম্বর রাতে ঘোড়াঘাটের ইউএনও ওয়াহিদা খানম ও তার বাবার ওপর হামলা হয়। এ ঘটনার পর থেকে পুলিশ নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় রবিউল ইসলাম নামে সাময়িক বরখাস্ত হওয়া সরকারি কর্মচারীকে আটক করা হয়। আটক রবিউল প্রাথমিকভাবে পুলিশের কাছে নিজের দায় স্বীকার করেছে। তার তথ্যের ভিত্তিতে আমরা বেশ কিছু আলামত উদ্ধার করেছি। এছাড়া তার বক্তব্য ও জব্দ করা সিসিটিভ ফুটেজের সঙ্গে মিল পাওয়া গেছে।
অপরদিকে, শুক্রবার (৪ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যায় সংবাদ সম্মেলনে রংপুর র্যাব-১৩ অধিনায়ক রেজা আহমেদ ফেরদৌস জানান, এ ঘটনার প্রধান আসামি আসাদুলের ভাষ্য অনুযায়ী চুরির উদ্দেশেই তারা ইউএনওর বাড়িতে প্রবেশ করেন এবং বাধাপ্রাপ্ত হওয়ায় হাতুড়ি দিয়ে পেটান। তবে আমরা আরও সময় নিয়ে গভীর তদন্ত করে এ ঘটনার মূল উদ্দেশ্য জানার চেষ্টা করছি। সন্দেহভাজনদের ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের পর সিসিটিভি ফুটেজে লাল গেঞ্জি পরিহিত ব্যক্তি তিনি নিজে এবং ঘটনার সঙ্গে নিজে জড়িত বলে স্বীকার করেন। তার বক্তব্য অনুযায়ী লাল গেঞ্জি উদ্ধার করা হয়।
রবিউলকে আটক করার পর থেকে শোকে কাতর মা রহিমা বেগম। তার দাবি ইউএনওর ওপর হামলার দিন তিনি বাড়িতে ছিলেন। সন্ধ্যার সময় পরিবারের সকলে মিলে একসঙ্গে টিভি দেখেছেন। রাতে একসঙ্গে খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছেন।
রবিউলের বড় ভাই শফিকুল ইসলাম জানান, ঘটনার দিন আমরা একসঙ্গেই ছিলাম। পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে রবিউল বাড়ির গরু-ছাগলের জন্য ক্ষেতে ঘাস কাটতে চান। ঘোড়াঘাটে ইউএনওর অফিসে কর্মরত থাকা অবস্থায় ইতোপূর্বে রবিউলের সঙ্গে একটা অন্যায় করা হয়েছিল। সেখানে ৫০ হাজার টাকা চুরির ঘটনায় তাকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়েছে। কিন্তু ওই চুরির ঘটনার সঙ্গে কোনোভাবে জড়িত ছিল না।
রবিউলের ভাবী শিউলি বেগম জানান, রবিউলকে আটকের পর ডিবি পুলিশ তার বাড়িতে এসে রবিউলের ব্যবহৃত চারটি শার্ট, চারটি প্যান্ট, একটি হাসুয়া, একটি লোহার রড নিয়ে গেছে। এছাড়াও রবিউলের শ্বশুরবাড়ি থেকে একটি হাতুড়ি নিয়ে গেছে।
রবিউলের মা রহিমা আরও বেগম জানান, ঘটনার পরের দিন রবিউল আমাদের বলতেছিল ‘মা আমি যদি ঘোড়াঘাটে উপস্থিত থাকতাম, তাহলে আমাকেও ইউএনওর ওপর হামলার ঘটনায় ফাঁসানো হতো। ভাগ্যিস আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম না’।
রবিউলের প্রতিবেশিরা জানান, রবিউল ইসলাম একজন ভাল ছেলে। নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়েন তিনি। তাই বিষয়টি অনেকেই মেনে নিতে পারছেন না। এলাকায় সবার সঙ্গে ভালো ব্যবহার করে সে। সে কোনো ধরনের খারাপ বা অপরাধমূলক কাজের সঙ্গে জড়িত এমন কোনো অভিযোগ এলাকাবাসীর জানা নেই।
মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ও পুলিশের গোয়েন্দা শাখার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইমাম জাফর জানান, আমাদের কাছে পর্যাপ্ত পরিমাণ তথ্য যে রবিউল এ ঘটনার সঙ্গে জড়িত। আমরা প্রমাণের ভিত্তিতে তাকে আটক করেছি।
উল্লেখ্য, বুধবার (২ সেপ্টেম্বর) রাতে ইউএনওর সরকারি বাসভবনের ভেন্টিলেটর ভেঙে বাসায় ঢুকে ওয়াহিদা ও তার বাবার ওপর হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। ইউএনওর মাথায় গুরুতর আঘাত এবং তার বাবাকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে গুরুতর জখম করা হয়। পরে ইউএনওকে প্রথমে রংপুর মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে (রমেক) নিয়ে ভর্তি করা হয়। এরপর তার অবস্থা আশঙ্কাজনক হওয়ায় উন্নত চিকিৎসার জন্য হেলিকপ্টারে করে তাকে ঢাকায় আনা হয়। তিনি বর্তমানে রাজধানীর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্স হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।
ওই দিন রাতেই হামলার শিকার ইউএনও ওয়াহিদা খানমের বড় ভাই শেখ ফরিদউদ্দীন বাদী হয়ে একটি মামলা দায়ের করেন। শনিবার (৫ সেপ্টেম্বর) মামলার আসামি রংমিস্ত্রি নবিরুল ইসলাম ও সান্টু রায়কেও সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট শিশির কুমার বসু। রিমান্ড শেষে ১১ সেপ্টেম্বর শুক্রবার আটক নবিরুল ও সান্টু রায়কে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। ১২ সেপ্টেম্বর শনিবার মামলার প্রধান আসামি আসাদুলের সাতদিনের রিমান্ড শেষ তাকেও আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। গত ৯ সেপ্টেম্বর বুধবার রাত ১টা ১০ মিনিটে রবিউলকে তার বাড়ি থেকে আটক করে ডিবি পুলিশ। ১২ সেপ্টেম্বর শনিবার রবিউলকে আদালতে সোপর্দ করে ১০দিনের রিমান্ড আবেদন করা হয়। বিজ্ঞ বিচারক ছয়দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।