সামরিক শাসনামলে প্রণীত ৪১ বছর আগের বিধিমালার একটি বিষয় নতুন করে সরকারি চাকরিজীবীদের মনে করিয়ে দিয়েছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এতে বলা হয়েছে, সংশ্লিষ্ট বিভাগীয় প্রধানের অনুমতি ছাড়া কেউ গণমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলতে পারবেন না। অর্থাৎ ওই বিধি মেনে চলতে হবে। বিশিষ্টজনরা মনে করছেন, এতে গণমাধ্যমে অবাধ তথ্যপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে, উৎসাহিত হবে গুজব।
করোনাকালে সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হচ্ছে। ঠিক তখনই এমন একটি আদেশ জনস্বার্থের বিরুদ্ধে যায় বলে মনে করেন গণমাধ্যমসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
সাবেক প্রধান তথ্য কমিশনার অধ্যাপক গোলাম রহমান বলেন, ‘প্রতিষ্ঠানের শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়ম থাকতেই পারে। কিন্তু সেটি সত্য প্রকাশে বাধা হলে তা কাম্য নয়।’ তিনি বলেন, ‘যত বেশি বাক্স্বাধীনতার উদারতা থাকবে প্রতিষ্ঠানে, তত স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠা হবে। যদি কেউ মিথ্যা তথ্য প্রকাশ করে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।’
বাংলাদেশ ফেডারেল ইনিয়ন অব জার্নালিস্ট-বিএফইউজের মহাসচিব শাবান মাহমুদ বলেন, ‘এ ধরনের আদেশ অত্যন্ত বিব্রতকর। মত প্রকাশের স্বাধীনতা দেশের সব নাগরিকের সাংবিধানিক ও মৌলিক অধিকার। কাউকে এই অধিকার থেকে বঞ্চিত করলে তথ্যপ্রবাহে অস্বচ্ছতা ও বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে।’ ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি কুদ্দুস আফ্রাদ বলেন, ‘তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। সামরিক আমলে প্রণীত এসব বিধিবিধান যাঁরা এখন মনে করিয়ে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছেন তাঁদের মাথায় অগণতান্ত্রিক ভূত চেপেছে। এতে গুজব, ভয় ও অস্বচ্ছতা বাড়বে। সামরিক আমলের এই বিধি বাতিল করা উচিত।’
১৯৭৯ সালের সরকারি কর্মচারী (আচরণ) বিধিমালার ২২ নম্বর বিধি অনুযায়ী, ‘সরকারি কর্মচারী বিভাগীয় প্রধানের পূর্বানুমোদন ব্যতিরেকে বেতার কিংবা টেলিভিশন সম্প্রচারে অংশগ্রহণ করতে বা কোনো সংবাদপত্র বা সাময়িকীতে নিজ নামে বা বেনামে বা অন্য নামে কোনো নিবন্ধ বা পত্র লিখতে পারবে না।’
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে গত ১৮ আগস্ট সব মন্ত্রণালয়ের সচিবদের কাছে পাঠানো চিঠিতে এই ব্যাপারে নজর রাখতে নির্দেশনা দিয়ে বলা হয়েছে, ‘বিধির ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোনো কোনো সরকারি কর্মচারী বিভাগীয় প্রধানের অনুমোদন ছাড়া কিংবা প্রকৃত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্র ছাড়া বিভিন্ন বিষয়ে বেতার ও টেলিভিশনের সংবাদ, টক শো, আলোচনা অনুষ্ঠান, পত্রপত্রিকা বা অনলাইন মাধ্যমে বক্তব্য বা মতামত বা নিবন্ধ বা পত্র প্রকাশ করছেন।’
প্রসঙ্গত, ওই বিধিতে এটাও বলা আছে, ‘যদি ওই সম্প্রচার বা নিবন্ধ বা পত্র সরকারি কর্মচারীর ন্যায়পরায়ণতা, বাংলাদেশের নিরাপত্তা অথবা বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্ব সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত না করে অথবা জনশৃঙ্খলা, শালীনতা, নৈতিকতার বিঘ্ন না ঘটায় অথবা আদালত অবমাননা না হয়, তবে এসব প্ররোচনা হিসেবে গণ্য হবে না।
আরো বলা হয়েছে, ‘ওই সম্প্রচার, নিবন্ধ বা পত্র যদি পুরোপুরি শিল্প-সাহিত্যধর্মী অথবা বিজ্ঞানভিত্তিক অথবা ক্রীড়া সম্পর্কিত হয়, তাহলে আগে থেকে অনুমোদন নেওয়ার প্রয়োজন হবে না।’
জনপ্রশাসন থেকে পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, বিভাগীয় কমিশনার, জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা যদি সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করার জন্য সম্প্রচারে অংশ নেন তাহলে বিভাগীয় প্রধানের অনুমোদনের প্রয়োজন হবে না।
এই বিষয়ে জানতে চাইলে জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন বলেন, ‘এটা অনেক আগের বিধিমালা, নতুন কিছু নয়। শুধু নতুন করে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘যেকোনো প্রতিষ্ঠান চালাতে গেলে কিছু নিয়ম-কানুন মানতে হয়। সরকারি চাকুরেরাও তার বাইরে নয়। সরকারি কাজে যুক্ত থাকার কারণে আমাকেও সরকারি নিয়ম-কানুন মেনে চলতে হয়।’