অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ থেকে রেহাই পেতে দুদকের পরিচালক এনামুল বাছিরকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ দেন ডিআইজি মিজানুর রহমান। যার মধ্যে ২০১৯ সালের ১৫ জানুয়ারি একটি বাজারের ব্যাগে করে ২৫ লাখ টাকা এনামুল বাছিরকে দেওয়ার জন্য রমনা পার্কে যান তিনি।
মিজান-বাছিরের ঘুষ লেনদেনের মামলায় বুধবার (১৯ আগস্ট) মামলার বাদী দুদকের উপ-পরিচালক শেখ মো. ফানাফিল্যা আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে একথা বলেন।
এদিন ঢাকার চতুর্থ বিশেষ জজ শেখ নাজমুল আলমের আদালতে সাক্ষ্য দেন মামলার বাদী দুদকের পরিচালক শেখ মো. ফানাফিল্যা।
মামলার বাদী ফানাফিল্যা তার জবানবন্দিতে বলেন, অনুসন্ধানে দেখা যায় ডিআইজি মিজানুর রহমান ২০১৯ সালের ১৫ জানুয়ারি একটি বাজারের ব্যাগে করে ২৫ লাখ টাকা এনামুল বাছিরকে দেওয়ার জন্য রমনা পার্কে যান। রমনা পার্ক থেকে আলোচনা শেষে ডিআইজি মিজানের গাড়িতে ওঠেন এনামুল বাছির।
গাড়িটি শাহজাহানপুরে থামলে মিজান ২৫ লাখ টাকা বাছিরের হাতে তুলে দেন। এরপর বাছির গাড়ি থেকে নেমে বাসায় যান। একইভাবে ২০১৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি রমনা থেকে মিজানের গাড়িতে উঠে শান্তিনগরে যান এনামুল বাছির। তখন মিজানুর রহমানের কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা নেন তিনি। এছাড়া মিজানের কাছে একটি গাড়ি দাবি করেন এনামুল বাছির। গাড়ি দাবির বিষয়টি লিখিতভাবে দুদকের কাছে স্বীকারও করেন তিনি।
জবানবন্দিতে ফানাফিল্যা আরও বলেন, মিজান ও এনামুল বাছির বেআইনিভাবে অন্যের নামে দু’টি সিম ব্যবহার করে মেসেজ আদান-প্রদান করতেন। একটি সিম কেনা হয় মিজানের বডিগার্ড হৃদয়ের নামে, আরেকটি সিম কেনা হয় মিজানের আরদালি সাদ্দামের নামে। মিজানের নির্দেশে একটি সিম এবং মোবাইল এনামুল বাছিরকে দেওয়া হয়। তাদের মধ্যে মেসেজ আদান-প্রদানের বিষয়টি ন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন (এনটিএমসি) মনিটরিং সেন্টারের ফরেনসিক কল রেকর্ডিংয়ে প্রমাণিত হয়।
তার জবানবন্দি গ্রহণের পর আসামিপক্ষ জেরা শুরু করলেও তা শেষ হয়নি। অসমাপ্ত জেরা ও পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য আগামী ২ সেপ্টেম্বর দিন ধার্য করেছেন আদালত।
এর আগে গত ১৯ জানুয়ারি মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের পরিচালক শেখ মো. ফানাফিল্যা এই মামলায় অভিযোগপত্র দাখিল করেন। এরপর ৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকার মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ কেএম ইমরুল কায়েশ মামলাটি বিচারের জন্য চার নম্বর বিশেষ জজ আদালতে বদলির আদেশ দেন।
গত ১৮ মার্চ এই মামলায় তাদের দু’জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর নির্দেশ দেন একই আদালত। ওইদিন সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য ২৩ মার্চ দিন ধার্য করেন আদালত। তবে করোনা পরিস্থতিতে আদালতের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে গেলে সাক্ষ্যগ্রহণ আর শুরু হয়নি।
গত ৫ আগস্ট থেকে নিয়মিত আদালত চালুর পর এই মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ১২ আগস্ট দিন ধার্য করা হয়। তবে সেই নির্ধারিত দিনে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা দুদকের পরিচালক শেখ মো. ফানাফিল্যা অসুস্থ থাকায় সাক্ষ্য দিতে আদালতে উপস্থিত হননি। তাই বিচারক সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ১৯ আগস্ট দিন ধার্য করেন।
গত বছর ৯ জুন একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে প্রচারিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে পরিচালিত দুর্নীতির অনুসন্ধান থেকে দায়মুক্তি পেতে দুদক পরিচালক বাছিরকে ৪০ লাখ টাকা ঘুষ দিয়েছিলেন ডিআইজি মিজান। ঘুষ লেনদেন সংক্রান্ত কথোপকথন রেকর্ড করে ওই চ্যানেলকে দিয়েছিলেন মিজান। ডিআইজি মিজানও এ বিষয়ে নিজেই গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেন। অবৈধ সম্পদ অর্জনের মামলা থেকে বাঁচতে ওই অর্থ ঘুষ দেন বলে ডিআইজি মিজান দাবি করেন।
এ প্রতিবেদন প্রচারিত হওয়ার পর দুদক সংস্থার সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখতকে প্রধান করে তিন সদস্যের উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে। কমিটি গত বছর ১০ জুন প্রতিবেদন জমা দেয়। প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে পরিচালক বাছিরকে দুদকের তথ্য অবৈধভাবে পাচার, চাকরির শৃঙ্খলাভঙ্গ ও সর্বোপরি অসদাচরণের অভিযোগে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করে কমিশন।
অন্যদিকে, ২০১৮ সালে একটি জাতীয় দৈনিকে ডিআইজি মিজানের বিরুদ্ধে এক সংবাদ পাঠিকাকে জোর করে বিয়ে করার সংবাদ প্রকাশের পর বিষয়টি ব্যাপক আলোচনার সৃষ্টি করে। ওই ঘটনায় পুলিশ সদর দপ্তরসহ দুদকে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। এরপর নানা জল্পনা-কল্পনা শেষে বিতর্কিত ডিআইজি মিজানকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনারের পদ থেকে প্রত্যাহার করে পুলিশ সদরদপ্তরে সংযুক্ত করা হয়। পরে গত বছর ২৫ জুন তাকে সাময়িক বরখাস্তের কথা সাংবাদিকদের জানান স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
এরপর গত বছর ১৬ জুলাই দুদক পরিচালক ও অনুসন্ধান টিমের দলনেতা শেখ মো. ফানাফিল্যা মানি লন্ডারিং আইনে সংস্থার ঢাকা-১ সমন্বিত জেলা কার্যালয়ে মামলাটি দায়ের করেন।
এরপরে ২২ জুলাই এনামুল বাছিরকে গ্রেফতার করে দুদকের একটি দল। সেই থেকে তিনি কারাগারে। অপরদিকে দুর্নীতির মামলায় গ্রেফতার ডিআইজি মিজানকে এই মামলায়ও গ্রেফতার দেখানো হয়।