চীনের বেসরকারি কোম্পানি সিনোভেকের টিকার তৃতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছে আইসিডিডিআরবি। আইসিডিডিআরবি ইতিমধ্যে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড রিসার্চ কাউন্সিলের (বিএমআরসি) কাছ থেকে ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের নীতিগত অনুমোদন পেয়েছে। কিন্তু ট্রায়াল পরিচালনার জন্য এই অনুমোদন যথেষ্ট নয় বলে বিভিন্ন স্তরের সরকারি কর্মকর্তারা গণমাধ্যমে বলেছেন।
টিকা প্রতিযোগিতা
করোনা মহামারির শুরু থেকে বিজ্ঞানীরা টিকা উদ্ভাবনে সচেষ্ট হন। কোভিড-১৯ বা করোনার টিকার হালনাগাদ পরিস্থিতি জানা যায় কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন ট্রাকারের ওয়েবসাইটে (https://www.covid-19vaccinetracker.org/)। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ওয়েবসাইটেও তথ্য পাওয়া যায়। এতে দেখা যাচ্ছে, এ পর্যন্ত ১৯৯টি টিকা তৈরি হয়েছে। তার মধ্যে ১৯টি টিকা ক্লিনিক্যাল ট্রায়ালের পর্যায়ে এসেছে। এর মধ্যে চূড়ান্ত পর্যায়ের দিকে এগিয়ে আছে যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ডের অ্যাস্ট্রোজেনিকা, যুক্তরাষ্ট্রের মডার্না, চীনের উহান ইনস্টিটিউট এবং সিনোভেকের টিকা। এই টিকাগুলো কতটা নিরাপদ ও কতটা কার্যকর, তা দেখার জন্য তৃতীয় পর্যায়ের ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল শুরু হয়েছে বিভিন্ন দেশে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, টিকার কার্যকারিতা দেখা হয় ভাইরাসের সামাজিক সংক্রমণ বজায় আছে এমন পরিস্থিতিতে। টিকাগুলোর মাঠপর্যায়ের ট্রায়াল হচ্ছে সেসব দেশে, যেখানে এখনো সামাজিক সংক্রমণ আছে। চীনে এখন সামাজিক সংক্রমণ নেই। যুক্তরাজ্য ও চীনা টিকার ট্রায়াল হচ্ছে অন্য দেশে।
দেশে টিকার আলোচনা
৭ মে টিকার আলোচনা প্রথম গণমাধ্যমে প্রকাশ করেন ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. মাহবুবুর রহমান। ওই দিন অধিদপ্তরে আইসিডিডিআরবি, ওষুধ কোম্পানি ইনসেপটা ও পপুলারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের সভা হয়েছিল। সভা শেষে মহাপরিচালক গণমাধ্যমকে বলেছিলেন, যুক্তরাজ্যের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বা চীনের টিকার ট্রায়ালের ব্যাপারে আলোচনা হয়েছে। দেশের দুটি ওষুধ কোম্পানির মাসে এক কোটি টিকা উৎপাদনের ক্ষমতা আছে। ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটও টিকা তৈরি করবে। ভারত থেকে টিকা আনার ব্যাপারেও যোগাযোগ করা হচ্ছে।
সূত্র বলছে, ওই আলোচনার পর আইসিডিডিআরবি কাগজপত্র তৈরি করে বিএমআরসি ও ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরে জমা দেয়।
এরপর ২৬ জুন বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরাম আয়োজিত ‘বাংলাদেশে করোনা: ছয় মাসের পর্যবেক্ষণ’ শীর্ষক অনলাইন সেমিনারে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদ চীনা টিকার ট্রায়াল আইসিডিডিআরবি করতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছিলেন।
বিএমআরসি ১৯ জুলাই আইসিডিডিআরবিকে টিকা ট্রায়াল করার নীতিগত অনুমোদন দেয়। এর পরদিন স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, টিকার ট্রায়াল দুই রাষ্ট্রের বিষয় এবং তাতে সিদ্ধান্ত নিতে সময় লাগে। তিনি আরও বলেছিলেন, করোনাবিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সঙ্গে ট্রায়াল বিষয়ে আলোচনা করা হবে। তবে গতকাল বুধবার পর্যন্ত এ বিষয়ে কোনো আলোচনা হয়নি।
কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক মোহাম্মদ সহিদুল্লা প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের কিছু জানানো হয়নি। কমিটি এ বিষয়ে কিছু জানে না।’ মোহাম্মদ সহিদুল্লা বিএমআরসির নীতিবিষয়ক কমিটির সদস্য।
অন্যদিকে দুই দিন আগে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব মো. আবদুল মান্নান বিবিসিকে বলেছেন, বিষয়টি নিয়ে চীন সরকার বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু না জানানোর কারণে তা নিয়ে কোনো আলোচনা বা অগ্রগতি নেই।
টিকা নিয়ে সাধারণ মানুষের আগ্রহ আছে। অনেকে মনে করেন, করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধের স্থায়ী সমাধান হতে পারে টিকা। আইসিডিডিআরবি এখন কী করছে, তা গতকাল সকালে আনুষ্ঠানিকভাবে জানতে চান এই প্রতিবেদক। রাতে আইসিডিডিআরবি বলেছে, ‘নো কমেন্ট’। তারা এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চায় না।
ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর কেন আইসিডিডিআরবিকে অনুমোদন দিচ্ছে না—এই প্রশ্নের উত্তরে অধিদপ্তরের পরিচালক মোহাম্মদ সালাউদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, এটি দুটি দেশের বিষয়। মন্ত্রণালয়ের সম্মতি না পেলে অধিদপ্তর অনুমোদন দিতে পারবে না।
আগের কোনো ট্রায়ালে মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন লাগেনি। এখন লাগবে কেন জানতে চাইলে মোহাম্মদ সালাউদ্দিন বলেন, ‘এখন জনস্বাস্থ্য জরুরি অবস্থা চলছে, মহামারি পরিস্থিতি চলছে, তাই মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন দরকার।’
মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের বিষয়ে জানতে স্বাস্থ্যসচিব (স্বাস্থ্য শিক্ষা বিভাগ) মো. আলী নূরের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, টিকার ট্রায়ালের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বিষয় জড়িত। সুতরাং এ ব্যাপারে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ওষুধ প্রযুক্তিবিদ প্রথম আলোকে বলেছেন, ট্রায়াল নিয়ে বিশ্বের কোথায় কী হচ্ছে, তার ওপর নজর রাখছেন বিজ্ঞানীরা, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান। ট্রায়ালের ব্যাপারে সরকারের অবস্থান দ্রুত স্পষ্ট করা দরকার। তা না হলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে ভবিষ্যতের বৈজ্ঞানিক গবেষণার ওপর।
টিকা আনার উদ্যোগ
সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তারা বলছেন, নিরাপদ ও কার্যকর টিকা উদ্ভাবন হলে সরকার সেই টিকা দেশের মানুষের জন্য আনার উদ্যোগ নিয়েছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, গ্যাভি (গ্লোবাল অ্যালায়েন্স ফর ভ্যাকসিনস অ্যান্ড ইমুনাইজেশন) ও আরও একাধিক আন্তর্জাতিক সংস্থা টিকার মজুত গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে। যে টিকাই প্রথম বাজারে আসুক না কেন, তার একটি অংশ নিম্ন ও নিম্নমধ্যম আয়ের দেশগুলোর মানুষের জন্য বরাদ্দ করার আন্তর্জাতিক প্রচেষ্টা আছে। এই উদ্যোগের নাম ‘কোভেক্স ফ্যাসিলিটি’।
৯ জুলাই স্বাস্থ্য অধিদপ্তর বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে কোভেক্স ফ্যাসিলিটিতে করোনার টিকার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করে আবেদন করে। ২১ জুলাই কোভেক্স ফ্যাসিলিটি অনলাইনে একটি বৈশ্বিক সম্মেলনের আয়োজন করে। তাতে অংশ নেয় বাংলাদেশ। সম্মেলনে সিদ্ধান্ত হয়েছে, নিম্ন ও নিম্নমধ্যম আয়ের দেশগুলোতে করোনা মোকাবিলায় সম্মুখসারির কর্মী, ৬৫ বছরের বেশি বয়সী মানুষ এবং দীর্ঘস্থায়ী রোগে ভুগছে এমন মানুষদের জন্য আগে টিকার ব্যবস্থা করা হবে। এদের সংখ্যা বাংলাদেশের জনসংখ্যার ২৩ শতাংশ। টিকা পাওয়ার প্রথম ছয় মাসে এদের টিকা দেওয়া হবে। এরপর টিকা পাওয়া সাপেক্ষে জনগোষ্ঠীর অন্যরা টিকা পাবে।
সরকারের মাতৃ ও শিশুস্বাস্থ্যসেবা কর্মসূচির লাইন ডিরেক্টর মো. শামসুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা যেন দ্রুত বেশি সংখ্যায় টিকা আনতে পারি, তার জন্য সম্ভাব্য সব ধরনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’