সার্টিফিকেট তুলতে চরম ভোগান্তির স্বীকার বুটেক্স শিক্ষার্থীরা

সার্টিফিকেট তুলতে চরম ভোগান্তির স্বীকার বুটেক্স শিক্ষার্থীরা

বুটেক্স প্রতিনিধি:স্নাতক শেষে সার্টিফিকেট ও গ্রেডশিট তুলতে প্রতিনিয়ত ভোগান্তির স্বীকার হচ্ছে বাংলাদেশ টেক্সটাইল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুটেক্স) শিক্ষার্থীরা। এক সার্টিফিকেট তুলতে ক্লিয়ারেন্স ফর্মে নেয়া লাগে কমপক্ষে নয়জনের স্বাক্ষর।

বুটেক্সের একজন শিক্ষার্থী যদি তার ১ম থেকে ৭ম সেমিস্টারের মার্কশীট সংগ্রহ করতে চায় তাহলে তাকে সেমিস্টারপ্রতি ২৫০ টাকা করে পেমেন্ট স্লিপ এক্সাম কন্ট্রোলাট অফিসে জমা দিতে হয়। কিছু সেমিস্টারের মার্কশীট সাথে সাথে পেয়ে যায়, কোন সেমিস্টারের মার্কশীট প্রিন্ট করা না থাকায় তাকে সপ্তাহখানেক অপেক্ষা করতে বলা হয়।

৮ম সেমিস্টারের মার্কশীট পেতে হলেও একজন শিক্ষার্থীকে বেশ ভোগান্তি পোহাতে হয়। প্রথমে ক্লিয়ারেন্স ফরম জমা দিতে হয়। নিজ বিভাগ থেকে ফরম সংগ্রহ করে লাইব্রেরির দুইজন, একাউন্ট সেকশনের দুইজন, রেজিস্ট্রার অফিসের দুইজন, হল প্রভোস্ট (অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের জন্য তিন হল প্রভোস্ট), নিজ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও সংশ্লিষ্ট ডিনসহ কমপক্ষে নয়জনের স্বাক্ষর নিতে হয়। স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে তার প্রায় দুই দিন সময় লাগে, কারণ কিছু অফিসার ব্যস্ত থাকায় তাকে অপেক্ষা করতে হয়।

সাময়িক/মূল সনদ পেতে হলে আবেদন ফরম (বিভাগীয় প্রধান ও ডিনের স্বাক্ষরসহ), অনলাইনে ৩,০১৫/- টাকা জমা দিয়ে তার পে-স্লিপ, শিক্ষার্থীর পরিচয়পত্র এবং লেভেল-৪ টার্ম-২ এর গ্রেডশিটসহ সকল গ্রেডশিট, রেজিস্ট্রার/পরিচালক, শিক্ষার্থী কল্যাণ কর্তৃক ইস্যুকৃত প্রসংশাপত্র, এইচ. এস. সি. সনদপত্রের সত্যায়িত ফটোকপি জমা দিতে হয়। সব ডকুমেন্ট নিয়ে এক্সাম কন্ট্রোলার অফিসে জমা দিলে সনদ প্রদানে এক সপ্তাহ সময় নেয়া হয়।

আবার ফলাফল ঘোষণার ৩০ কার্য দিবসের মধ্যে মূল সনদের জন্য এবং ১০ কার্য দিবসের মধ্যে সাময়িক সনদের জন্য আবেদন করা যাবে না এমন নিয়মও রয়েছে। উল্লেখ্য এখানে সনদ ফি-এর সাথে অতিরিক্ত সমাবর্তন ফি ২৫০০ টাকা। কিন্তু আদৌও এই সমাবর্তন কবে হবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪২তম ব্যাচের শিক্ষার্থী মো: রফিকুল ইসলাম অভিযোগ করে বলেন, ‘সার্টিফিকেট প্রোভিশনাল হয়, গ্রেডশিট নয়। অথচ বুটেক্স ভুল করে এই শব্দটি রেজাল্ট শিটে লিখেছে। এখন আমাদের পুনরায় ফি প্রদান করে সংশোধিত কপি নিতে হবে। বাইরের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন গ্রেডশিট গ্রহণযোগ্য নয়। এমনকি মাস্টার্সের গ্রেডিং সিস্টেমেও ভুল স্কেল দেওয়া হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের কোনো জবাবদিহিতা নেই, কর্তৃপক্ষেরও কোনো উদ্যোগ নেই।’

তিনি আরও বলেন, ‘গ্রেড শিটে “ডেপুটি” শব্দটি কলম দিয়ে কেটে সিগনেচার করা হয়েছে। এটি কোনোভাবেই প্রাতিষ্ঠানিক রীতি হতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের এ বিষয়ে কোনো জবাবদিহিতা নেই, কর্তৃপক্ষেরও কোনো উদ্যোগ নেই।’

বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৪তম ব্যাচের শিক্ষার্থী আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘আমি নিজেও বুটেক্সের পরীক্ষানিয়ন্ত্রক দপ্তরের জটিল ও সময়সাপেক্ষ ম্যানুয়াল পদ্ধতির ভুক্তভোগী। সার্টিফিকেট ও মার্কশিট তুলতে আমাকে ১০ জনেরও বেশি কর্মকর্তার স্বাক্ষর নিতে হয়েছে। এর পাশাপাশি পরীক্ষানিয়ন্ত্রক দপ্তরের অনেক কর্মকর্তার ব্যবহারও ছিল অমানবিক। শিক্ষার্থীদের সঙ্গে তারা যেন অপরাধী হিসেবে কথা বলেন। আমার সৌভাগ্য, আমি শেষ পর্যন্ত প্রয়োজনীয় কাগজপত্র সংগ্রহ করতে পেরেছি। কিন্তু মার্কশিটে এখনো বানান ভুল রয়েছে। তিনি আরও বলেন, আমরা অনেকেই এই প্রক্রিয়ার পরিবর্তনের জন্য চেষ্টা করেছি, কিন্তু সফল হইনি। আমাদের মৌলিক প্রয়োজনের এই জায়গাগুলোতেই যদি পরিবর্তন না আসে, তাহলে শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ আরও জটিল হয়ে উঠবে। আশা করি সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখবেন।’

শিক্ষার্থীদের এমন অভিযোগের প্রেক্ষিতে বুটেক্সের দায়িত্ব প্রাপ্ত পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক রেজাউল হক বলেন, ‘আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়েও আগে প্রভেশনাল গ্রেডশিট দেয়া হয়। তাই আমরাও এখানে দিতাম। তবে শিক্ষার্থীরা এব্যাপারে অভিযোগ করায় আমরা ৬ মাস আগেই নিয়ম পরিবর্তন করেছি এখন থেকে গ্রেড শিটের মূল কপি দিচ্ছি। তবে আগের ব্যাচের শিক্ষার্থী যারা গ্রাজুয়েশন শেষ করে বের হয়ে গেছেন তাদের গ্রেডশিটগুলো প্রভেশনাল লিখেই তৈরি করা আগেই হয়ে গিয়েছিল এবং এতগুলো গ্রেডশিটকে পরিবর্তন করা সম্ভব নয় এখানে একটা বাজেটের বিষয় থাকে।’

প্রভেশনাল গ্রেড শিট জমা দিয়ে মূলকপি তুলতে কেন পুনরায় টাকা দেয়া লাগে এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এই টাকা বুটেক্স প্রশাসন কতৃক নির্ধারিত। এটা বুটেক্সের ফান্ডে জমা হয়। যদি প্রশাসন নিয়ম পরিবর্তন করে তাহলে আমরাও শিক্ষার্থীদের থেকে অর্থ নিব না। সম্প্রতি শিক্ষার্থীদের অভিযোগ শুনে উপাচার্য আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রভেশনাল গ্রেডশিট জমা দিয়ে মূল মার্কশিট তোলার জন্য কোন অর্থ না নিতে। তাই আমরাও এখন থেকে আর কোন অর্থ নিব না।’

মাস্টার্সের মার্কশিটে বিএসসিএর নিয়মে গ্রেডিং লেখা এমন অভিযোগের জবাবে রেজাউল করিম বলেন, ‘পূর্বে মাস্টার্স এবং বিএসসি এর গ্রেডিং পদ্ধতি একই ছিল। পরবর্তীতে মাস্টার্স এবং বিএসসির গ্রেডিং পদ্ধত আলাদা করা হয়। কিন্তু মার্কশিটে সেটা পরিবর্তন করা হয় নি। যে শিক্ষার্থী অভিযোগ করেছেন তার মার্কশিটে আগের পদ্ধতিতে গ্রেডিং লেখা থাকায় আমরা তাকে মার্কশিট দিতে চাই নি এবং পরবর্তীতে নেয়ার জন্য বলি। কিন্তু তার জরুরি ভিত্তিতে মার্কশট প্রয়োজন ছিল এবং তিনি অনেক অনুরোধ করায় আমরা তাকে মার্কশিট টি দেই। তবে পরবর্তী সময় থেকে এসমস্যাগুলি আর হবে না।’

মার্কশিটে কেন তার পদবী ডেপুটি কন্ট্রোলার থেকে ডেপুটি কথাটা কলম দিয়ে কেটে দিয়েছেন এমন প্রশ্নের জবাবে রেজাউল করিম বলেন, ‘আমি দীর্ঘ ১১ বছর ডেপুটি কন্ট্রোলার পদে ছিলাম। আমাকে সম্প্রতি কন্ট্রলারের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। আর যেহেতু মার্ক শিটগুলো আগে থেকেই তৈরি করা থাকে তাই সেখানে আমার পূর্বের পদবী ডেপুটি কন্ট্রোলার রয়ে গিয়েছিল। তাই আমি ডেপুটি কথাটি কেটে দিয়েছি।’

তবে রেজাউল হক জানান তারা নানা সীমাবদ্ধতার মাঝে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন। বুটেক্সে এখনো অটোমেশন না আসায় তাদের সনাতন পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র প্রনোয়ন, রুটিন তৈরি সহ যাবতীয় কাজ করতে হয়। বিশেষ করে অটোমেশন এবং পর্যাপ্ত লোকবল না থাকায় তাদের সব থেকে বেশি সমস্যা হচ্ছে। এমনকি বুটেক্সের অধিভুক্ত ১২ টি কলেজে মাত্র ৩ জন পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক রয়েছে। এর মধ্যে ২ জনই অস্থায়ী দায়িত্ব প্রাপ্ত। এসব সীমাবদ্ধতার কারণে মার্কশিট, সার্টিফিকেট তৈরিতে দীর্ঘ সময় লাগে ফলে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক দপ্তর শিক্ষার্থীদের কাঙ্খিত সেবা দিতে পারছেনা। এজন্য তারা দুঃখপ্রকাশ করেন এবং প্রশাসনের নিকট এসকল সমস্যার দ্রুত সমাধান চান।
এছাড়াও কন্ট্রোলার দপ্তরে কর্মরত কর্মকর্তারা প্রমোশন সংক্রান্ত জটিলতার সম্মুখীন হচ্ছেন বলেও অভিযোগ জানান।

জটিল পদ্ধতি আর একাধিক কর্মকর্তার স্বাক্ষর প্রয়োজনের বিষয়ে ডেপুটি রেজিস্ট্রার জনাব মোহাম্মদ শরিফুর রহমান বলেন, ‘অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের তুলনায় আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে জটিলতা কম৷ একজন ছাত্রকে মেইন সার্টিফিকেট দেয়ার পূর্বে তার কোনো ধরনের বকেয়া রয়েছে কিনা এটা নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব। পূর্বে পদ্ধতি আরও জটিল ছিলো এবং আরও অনেকের স্বাক্ষর প্রয়োজন হতো। বর্তমানে সেটি অনেক কম। এখন কেবল একজন ছাত্রের মৌলিক বিষয় যেমন লাইব্রেরী, হল, ডিপার্টমেন্ট, একাডেমিকস ও একাউন্টস থেকে ক্লিয়ারেন্স প্রয়োজন হয়৷’

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. জুলহাস উদ্দিন বলেন, ‘আমি দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকে শিক্ষার্থীদের ভোগান্তি অনেকাংশে কমেছে। গত অক্টোবর থেকে নতুন যারা গ্রেডশিট তুলছেন তাতে আর প্রভোশনাল লেখা নেই। প্রশাসনের যেকোনো ভুলের কারণে যদি কারো সার্টিফিকেট অথবা গ্রেডশিটে সমস্যা হয় তার ভর্তুকি বিশ্ববিদ্যালয় দিবে।’

তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেকগুলো প্রজেক্ট চলমান যার মধ্যে অটোমেশন অন্যতম। আর জনবল সংকট নিরসনে আমরা ইউজিসি বরাবর চিঠি দিয়েছি। ইতিমধ্যে অনেকগুলো নিয়োগ স্বাক্ষর হয়েছে সামনে আরও কিছু নিয়োগ হবে যাতে আমাদের দাপ্তরিক কাজ ত্বরান্বিত হবে।’

সার্টিফিকেট তুলতে সমাবর্তনের ফি কেন দিতে হবে যেখানে সমাবর্তনের তারিখ এখনো সুনির্দিষ্ট নয় এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক ড. মো. জুলহাস উদ্দিন বলেন, ‘এটি পূর্ববর্তী ভিসির সময়কালে সিন্ডিকেটের নেয়া সিদ্ধান্ত। তবে আমি সমাবর্তনের ব্যাপারে সর্বদা সচেষ্ট। বিগত ৬ মাসে আমি তিনবার মন্ত্রণালয়ের কাছে আবেদন করেছি, বাকী সিদ্ধান্ত তাদের হাতে। আমরা সকলভাবে সমবর্তন আয়োজনে প্রস্তুত। আমরা চাই একজন নোবেল নোবেল লরিয়েটকে আমাদের সমাবর্তনে আনতে, তার সময়সূচি পেলেই আনুষ্ঠানিক প্রস্তুতি শুরু হবে।’

এছাড়াও তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ও প্রাক্তন শিক্ষার্থীদের যেকোনো সমস্যায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আক্রমণাত্মক ও কুরুচি সম্পন্ন মতামত না করে তা সরাসরি উপাচার্যকে অবহিত করার আহ্বান জানান। তিনি সে সমস্যা সমাধানের সর্বাত্মক চেষ্টা করবেন বলে আস্বস্ত করেন।

Leave a reply

Minimum length: 20 characters ::