নিজস্ব প্রতিবেদক : সামাজিক অচলায়তন ভেঙে নারীদের এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘কিছু বাধা আসে, আসবে। সেই বাধা অতিক্রম করেই এগিয়ে যেতে হবে।বৃহস্পতিবার (৯ ডিসেম্বর) সকালে ‘বেগম রোকেয়া দিবস-২০২১’ ও ‘বেগম রোকেয়া পদক-২০২১’ প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন।রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আয়োজিত এ অনুষ্ঠান থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে মহিলা ও শিশু বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুন নেসা ইন্দিরা ‘বেগম রোকেয়া পদক’ বিজয়ীদের হাতে পদক তুলে দেন। এ সময় গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সে সংযুক্ত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী।প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমাদের ইসলাম ধর্মে তো মেয়েদের অধিকার দেওয়াই আছে। এখানেই তো সম অধিকারের কথা বলা আছে। কিন্তু তারপরও আমাদের দেশে কিছু এ ধরনের বাধা আসে, আসবে। কিন্তু সেই বাধা আমাদের অতিক্রম করেই এগিয়ে যেতে হবে। ’এ প্রসঙ্গে প্রবল বাধার মুখেও দেশে নারীদের ফুটবল চালুর কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘খেলাধুলায় মেয়েদের তো অংশ গ্রহণই করতে দিত না। যাই হোক দ্বিতীয় বার যখন সরকারে আসলাম, অন্যভাবে ব্যবস্থা নিতে হয়েছে। আমরা প্রাথমিক থেকে স্কুলে স্কুলে প্রতিযোগিতা শুরু করলাম বঙ্গমাতা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ফুটবল টিম এবংমাধ্যমিক থেকে উচ্চ পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফুটবল টিম। এভাবে ছোটবেলা থেকে যখন খেলা শুরু করল, এখন আর সেই বাধাটা আসে না। ’ ‘অর্থাৎ অচলায়তন ভেঙে একবার এগিয়ে যেতে পারলে আর কোন বাধা আসবে না। ’নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে চিন্তা-চেতনা পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এখন যে জিনিসটা সবচেয়ে আমাদের জন্য পীড়াদায়ক সেটা হচ্ছে মেয়েদের ওপর সহিংসতা। যদিও আমরা আইন করে দিয়েছি। আমরা ধর্ষণের বিরুদ্ধে আইন করেছি, আমরা নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে আইন করেছি। ’‘শুধু আইন করলে হবে না, এখানে মানসিকতাও বদলাতে হবে। চিন্তা-চেতনার পরিবর্তন আনতে হবে। ’প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিশ্বাসটা হচ্ছে সবচেয়ে বড় জিনিস। বিশ্বাসটা করতে হবে। নারীরা শুধু ভোগের বস্তু না, নারীরা সহযোদ্ধা, সহযোগী। সহযাত্রায় চলতে হবে। সমান অধিকার দিতে হবে। এটাই হলো বাস্তবতা। সেভাবেই কাজ করতে হবে। সব জায়গায় নারী-পুরুষ সমানভাবে কাজ করছে বলেই দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। এগিয়ে যাবে। ’শেখ হাসিনা বলেন, ‘পুরুষ শাসিত সমাজ আমরা বলি। কিন্তু মেয়েদের ছাড়া পুরুষরা কি পথ চলতে পারে? পারে না। মায়ের পেটে জন্ম নিতে হবে, বোনের হাত ধরে হাঁটা শিখে, বড় হয়ে স্ত্রীর ওপর নির্ভরশীল থাকে, বৃদ্ধ হয়ে গেলে তো কন্যা সন্তানই বেশি দেখে, সেই যত্ন নেয় বেশি, এটাও তাদের মনে রাখতে হবে। ’সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে সফলতার সঙ্গে নারীদের দায়িত্বপালনের কথা তুলে ধরে সরকার প্রধান বলেন, ‘বেগম রোকেয়া যে স্বপ্ন দেখেছিলেন আমি মনে করি অনেকটাই আমরা পূরণ করতে সক্ষম হয়েছি। ’শেখ হাসিনা বলেন, ‘অনেক ঝুঁকিপূর্ণ জায়গায় যেয়ে আমাদের মেয়েরা কাজ করে। আমাদের যুদ্ধ বিমানও তারা চালাচ্ছে। কাজেই সব দিক থেকে মেয়েরা কিন্ত পিছিয়ে নেই। কাজেই এটা সবচেয়ে বড় কথা পুরুষরা যেটা পারে নারীরা তার চেয়ে আরও ভালো পারে, বেশি পারে এতে কোন সন্দেহ নেই। এটাই প্রমাণ হয়েছে। ’বিভিন্ন সেক্টরে নারীদের সফলতার কথা বলতে গিয়ে রসিকতা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি বেশি বলবো শেষে আবার দেখা যাবে পুরুষরা… আবার ভোট কমে না যায় সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। কারণ আমাদের তো ইলেকশন করে আসতে হয়। সব দিকে লক্ষ্য রাখা দরকার। ’শেখ হাসিনা বলেন, ‘বেগম রোকেয়া আমাদের আদর্শ। তিনি নারীদের পথ দেখিয়েছেন। তার সময়ে সমাজে নারীদের লেখাপড়া যেন অপরাধ ছিল। সেই অবস্থা থেকে তিনি নারী জাগরণে কাজ করেছেন। এখন মেয়েরা কোন দিক থেকে পিছিয়ে নেই। বরং পুরুষরা যেটা পারে নারীরা তার থেকে আরও ভাল পারে, বেশি পারে; এতে কোন সন্দেহ নেই। সেটাই প্রমাণ হয়েছে। ’নারী শিক্ষার প্রসার এবং কর্মক্ষেত্রে নারীদের সুযোগ করে দিতে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা প্রথমবার যখন সরকার গঠন করি নারী শিক্ষা অবৈতনিক করেছি। পাশাপাশি প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশ নারী শিক্ষক বাধ্যতামূলক করি। এই সিদ্ধান্তের পর অনেক বাবা-মা মেয়েদের বাধা দেয়নি। অন্তত মেয়ে যে একটা চাকরি পাবে সেটা তারা উপলব্ধি করতে পেরেছে। তাছাড়া কমিনিটি ক্লিনিকে মেয়েদের কর্মের ব্যবস্থা হয়। সর্বক্ষেত্রে একটা উদ্যোগ নিতে চেষ্টা করেছি। ’নারীর ক্ষমতায়ন ও অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে এ বছর পাঁচজন বিশিষ্ট নারীকে ‘বেগম রোকেয়া পদক-২০২১’ দেওয়া হয়। পদকপ্রাপ্তদের তাদের প্রত্যেককে চার লাখ টাকার চেক, রেপ্লিকাসহ একটি ১৮ ক্যারেট মানের ২৫ গ্রাম ওজনের স্বর্ণ পদক ও সম্মাননাপত্র দেওয়া হয়।নারী শিক্ষায় বিশেষ অবদানের জন্য কুমিল্লা জেলার অধ্যাপিকা হাসিনা জাকারিয়া বেলা; নারী অধিকার প্রতিষ্ঠায় যশোরের অর্চনা বিশ্বাস; নারীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে অবদান রাখায় কুমিল্লার শামসুন্নাহার রহমান পরাণ (মরোণোত্তর); সাহিত্য ও সংস্কৃতির মাধ্যমে নারী জাগরণের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও রোকেয়া হলের প্রভোস্ট ড. জিনাত হুদা এবং পল্লী উন্নয়নে অবদান রাখায় কুষ্টিয়ার গবেষক ড. সারিয়া সুলতানাকে এ বছর রোকেয়া পদক দেওয়া হয়।১৮৮০ সালের ৯ ডিসেম্বর রংপুর জেলার মিঠাপুকুর উপজেলার পায়রাবন্দ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া। ১৯৩২ সালের একই তারিখে কলকাতার সোদপুরে তার মৃত্যু হয়। বেগম রোকেয়ার জন্ম ও মৃত্যুবার্ষিকীতে প্রতিবছর এ পুরস্কার দেয় বাংলাদেশ সরকার। লেখনির মাধ্যমে বাল্যবিয়ে, যৌতুক, পণ প্রথা, ধর্মের অপব্যাখ্যা, কুসংস্কারসহ নারীর প্রতি অন্যায়-আচরণ ও বৈষম্যে বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন বেগম রোকেয়া।