নিজস্ব প্রতিবেদক : মাতৃভাষা বাংলাকে নিয়ে কবি অতুলপ্রসাদ সেনের ‘মোদের গরব, মোদের আশা’ কবিতায় লিখেছেন-‘মোদের গরব, মোদের আশা,/আ মরি বাংলা ভাষা!/তোমার কোলে তোমার বলে কতই শান্তি ভালবাসা।’ এমন অনেক কবিতা গল্প উপন্যাস রচিত হযেছে মায়ের ভাষা বাংলাকে ঘিরে তার হিসাব বলা মুশকিল। পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী এরপর ‘৫২ থেকে ‘৭১ সাল পর্যন্ত বীরদর্পে বাঙ্গালীদের শাসন শোষণ করে গেছে। তাদের সেই দর্প চুর্ণ করে মহান স্বাধীনতার ডাক দেন বঙ্গবদ্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ‘৫২ সালে বাংলার ছাত্র জনতা মায়ের ভাষা রক্ষা করার জন্য যেভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, ঠিক একইভাবে ‘৭১ সালেও পাকিদের কাছ থেকে স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনে।
মাতৃভাষা বাংলাকে নিয়ে বদরুদ্দীন উমরের ‘পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি’ (তৃতীয় খন্ড) গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ১৯৫২ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি ‘প্রাদেশিকতা’ শীর্ষক নামে করাচী থেকে প্রকাশিত মুসলিম লীগ সমর্থক ইংরেজী দৈনিক পত্রিকা ‘ডন’ এর একটি সম্পাদকীয়তে প্রাদেশিকতাকে পাকিস্তানের সব থেকে বড় শত্রুরূপে আখ্যায়িত করা হয় এবং পূর্ব বাংলার ভাষা প্রসঙ্গ উত্থাপন করে বলা হয়, ‘ভাষা প্রশ্নকে যুবকদের কাছে একটা আবেগময় আবেদন আছে, কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে একটি খুব শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যে সব মানুষ কায়েদে আযমের জীবদ্দশায় কোন দিন মাথা তোলার সাহস আগ্রহ্য করতে।’ এর পর ১৯৪৮ এর মার্চ মাসে ঢাকাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের সমানে ভাষা প্রসঙ্গে জিন্নাহর উক্তি উদ্ধৃত করে সম্পাদকীয়টিতে বলা হয় যে, সে সময় কেউ সেই বক্তব্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেনি। কিন্তু গত সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন যখন সেই একই তথাগুলি পুনরাবৃত্তি করেন তখন সেই একই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা তাদের বিক্ষোভ প্রদর্শনের উদ্দেশ্যে ধর্মঘট করেছে বলে জানা গেছে। কার প্রভাবে এই ছাত্রদেরকে জাতির পিতার বিরুদ্ধে এই অসম্মান প্রদর্শন করতে বলা হয়েছে সেটা কি স্পষ্ট নয়? এই প্রভাব যা আসলে পাকিস্তানের শত্রুদেরই প্রভাব, নিশ্চিহ্ন করতে হবে যদি পাকিস্তানকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকতে হয়। যারা আমাদের রাষ্ট্রের বুনিয়াদকে খর্ব করতে বদ্ধপরিকর তাদের কাছে স্পষ্ট ভাষায় কথা বলার সময় এসেছে।…যারা প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে প্রাদেশিকতার পক্ষে ওকালতি করে তাদের রাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে ঘোষণা করা এবং কোন প্রকার প্রশ্রয় না দেয়া উচিত।’ ‘ডনের’ এই ‘সম্পাদকীয়টিতে শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে একজন প্রাদেশিকতাবাদী হিসেবে আখ্যায়িত করে বলা হয় যে, তিনি পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্বশাসনের ধ্বনি তুলে সেই ধ্বনিকে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে একটা হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন।‘
পাঞ্জাব থেকে নির্বাচিত সংবিধান সভার সদস্য চৌধুরী নাজির আহমেদ ভান ভাষা প্রশ্নে নাজিমুদ্দিনের একটি উক্তির প্রতিবাদ করে সংবাদপত্রে বিবৃৃতির মাধ্যমে বলেন, ‘একটি রিপোর্ট অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকায় একটি সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে সে বিষয়ে সংবিধান সভাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। এই মন্তব্য টেকনিক্যাল দিক দিয়ে সঠিক হতে পারে কিন্তু যেহেতু প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেছেন সেজন্য এর থেকে এই বিপদ ঘটতে পারে যে যার সংকীর্ণতা বা প্রাদেশিতকার কারণে আমাদের জাতীয় ঐক্যের মধ্যে ফাটল ধরাতে চায় তারা একে ভুল বুঝতে পারে এবং এর অপব্যবহার করতে পারে। উর্দু যে পাকিস্তানের জাতীয় ভাষারূপে প্রত্যেক সরকারী মুখপাত্র এবং দায়িত্বশীল নেতার দ্ধারা পাকিস্তানের প্রথম থেকেই স্বীকৃত হয়েছে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। খাজা সাহেবের বিবৃতির আরও ব্যাখ্যা খুবই প্রয়োজন অন্যথায় আমি আশঙ্কা করি যে, এর ফলে বিতর্ক ও তিক্ততার সিংহদ্বার খুলে যাবে, যার পরিণতি দাঁড়াবে খুব খারাপ।’
১৯৫২ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিনের ঘোষণার প্রতিবাদে সারাদেশে পালিত হলো হরতাল, ছাত্রসভা। নেতৃত্ব দিলেন ছাত্রনেতা গাজীউল হক। স্কুল কলেজ ঘুরে ছাত্রদের উদীপ্ত করেন তিনি, ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে সব হলের ছাত্রদের সংগঠিত করলেন। একুশের সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার মিটিংয়ে সভাপতিত্ব করেন তিনিই। ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র জনতার মিছিলে গুলি চালাল পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী। শহীদ হলেন রফিক, সালাম, বরকত, জব্বারসহ আরও অনেকে। এমন অনেক আত্মত্যাগ আর সংগ্রামের ফসল মাতৃভাষা বাংলা। প্রতিবাদে গণপরিষদের অধিবেশন বয়কট করলেন ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত। রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে ‘৪৮ এর ২৩ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে তিনিই প্রথম দাবি জানান রাষ্ট্র ভাষা বাংলার।
অনেক বছর পরে হলেও বাংলাভাষাকে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা (ইউনেস্কো) ১৯৯৯ সালের ১৭ নবেম্বর তাদের ৩০তম সম্মেলনে ২৮টি দেশের সমর্থনে ২১ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ২০০০ সাল থেকে বিশ্বের ১৮৮ দেশে ২১ ফেব্রুয়ারিকে মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হয়ে আসছে। রক্তস্নাত ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবহ মহান শহীদ দিবস। এই দিনটি জাতির জীবনে অবিস্মরণীয় ও চিরভাস্বর হয়ে উঠেছে। ১৯৫২ সালের এই দিনে মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা রাখতে গিয়ে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়েছিল রফিক, সালাম, বরকত, সফিউর জব্বাররা। তাঁদের রক্তে শৃঙ্খলমুক্ত হয়েছিল দুঃখিনী বর্ণমালা, মায়ের ভাষা। বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের যে সংগ্রামের সূচনা সেদিন ঘটেছিল।