চিকিৎসক সঙ্কট চরমে উপজেলা স্বাস্থ্য খাতে বেহাল দশা

চিকিৎসক সঙ্কট চরমে উপজেলা স্বাস্থ্য খাতে বেহাল দশা

নিজস্ব প্রতিবেদক : স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স বা উপজেলা হাসপাতালই হচ্ছে তৃণমূলে সরকারি স্বাস্থ্যসেবার প্রধান মাধ্যম। ওই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেই গ্রামীণ পর্যায়ে প্রাথমিক ও জরুরি স্বাস্থ্যসেবা দেয়া হয়। কিন্তু দেশের অধিকাংশ উপজেলাতেই স্বাস্থ্য খাত খুবই নাজুক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। কেবলমাত্র ঢাকা ছাড়া দেশের প্রতিটি বিভাগেই উপজেলা হাসপাতালগুলোতেই খালি পড়ে থাকে অর্ধেকের বেশি চিকিৎসকের পদ। কোনো কোনো বিভাগে শূন্য পদের এ হার ৭০ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। ফলে চিকিৎসক না থাকায় সরকারি স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। উপায়ন্তর না থেকে বাধ্য হয়েই স্বাস্থ্যসেবা নিতে গস্খামীণ মানুষকে শহরে ছুটতে হয়। তাতে একদিকে যেমন গ্রামের মানুষের ভোগান্তি ও চিকিৎসা ব্যয় বাড়ছে। অন্যদিকে শহরের হাসপাতালগুলোয় বাড়ছে ভিড়। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশের ৪৯২টি উপজেলায় চিকিৎসকের বিভিন্ন পদক্রমে ১০ হাজার ৪৭১টি পদের অনুমোদন রয়েছে। তার মধ্যে বর্তমানে ৪ হাজার ৩৪১টি পদে চিকিৎসক কর্মরত রয়েছে। বাকি পদগুলো খালি। পরিস্থিতি মোকাবেলায় সরকার বিশেষ বিসিএসের মাধ্যমে নিয়োগ দিয়ে গ্রামের চিকিৎসক সংকট কাটানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু তা খুব একটা কাজে দিচ্ছে না। কারণ চিকিৎসকরা গ্রামে থাকতে আগ্রহী হচ্ছে না। আর তার অন্যতম কারণ হচ্ছে চিকিৎসকরা গ্রামে জীবনযাপনে শহরের মতো সুযোগ-সুবিধা ও প্রাইভেট হাসপাতালে প্র্যাকটিসের সুযোগ না থাকা। তাছাড়া সন্তানদের পড়াশোনা, পরিবার-পরিজন ও আত্মীয়স্বজনের কাছাকাছি থাকার প্রয়োজনীয়তা থেকেও অনেক চিকিৎসক উপজেলা থেকে বদলি হয়ে মহানগর কিংবা জেলা শহরে চলে যেতে বেশি আগ্রহী। আবার তরুণ চিকিৎসকদের একটি অংশ উচ্চতর শিক্ষার জন্য ছুটি নিয়ে কর্মস্থল থেকে দূরে অবস্থান করে।
সূত্র জানায়, দেশের আটটি বিভাগে ৪৬৬টি ‘উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা’ পদের বিপরীতে কর্মরত রয়েছে ৪৫৫ জন। ৪০৯টি আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) পদের বিপরীতে কর্মরত আছে মাত্র ১৫৬ জন। ২ হাজার ৭৩৭টি জুনিয়র কনসালট্যান্ট পদের বিপরীতে কর্মরত রয়েছে ১ হাজার ১০২ জন। তাছাড়া জুনিয়র কনসালট্যান্ট (গাইনি) পদে কর্মরত ২৩০ জন ও জুনিয়র কনসালট্যান্ট (অ্যানেস্থেটিস্ট) পদে ১৪২ জন কর্মরত আছে। তার বাইরে ৭ হাজার ২৪২টি গ্রেড-৯ চিকিৎসক পদের বিপরীতে কর্মরত রয়েছে মাত্র ২ হাজার ৭৭৩ জন। ৩৩তম বিসিএস থেকে নিয়োগপ্রাপ্ত রয়েছে ১ হাজার ৬৭ জন। অন্যান্য চিকিৎসক (গ্রেড-৯) আছে ১ হাজার ৭০৬ জন, যারা অ্যাডহকে নিয়োগপ্রাপ্ত।
সূত্র আরো জানায়, উপজেলা পর্যায়ে বরিশাল বিভাগে চিকিসকের পদ সবচেয়ে বেশি খালি পড়ে রয়েছে। আর ঢাকা বিভাগে চিকিৎসকের শূন্য পদ সবচেয়ে কম। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের শয্যার সংখ্যাভেদে বিভিন্ন উপজেলায় চিকিৎসকের সংখ্যাও কমবেশি হয়। বরিশাল বিভাগের উপজেলাগুলোয় মোট পদের বিপরীতে সবচেয়ে বেশি (৭৪ শতাংশ) পদ খালি রয়েছে। ওই বিভাগে ৩৮টি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা পদের বিপরীতে কর্মরত রয়েছে ৩৭ জন, ৩২টি আরএমও পদের বিপরীতে কর্মরত রয়েছে মাত্র ১২ জন, ২২২টি জুনিয়র কনসালট্যান্ট পদের বিপরীতে রয়েছে মাত্র ৩২ জন, ৫৫৫টি চিকিৎসক (গ্রেড-৯) পদের বিপরীতে ১৪৭ জন কর্মরত রয়েছে। খুলনা বিভাগের ৫৮টি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা পদের একটিও খালি না থাকলেও ৪৯টি আরএমও পদের বিপরীতে মাত্র ৮ জন কর্মরত রয়েছে, ৩৪৫টি জুনিয়র কনসালট্যান্ট পদের বিপরীতে ৮৮টি জন কর্মরত ও ৯২২টি চিকিৎসক (গ্রেড-৯) পদের বিপরীতে ২৮৫ জন কর্মরত আছে। সিলেট বিভাগের ৩৮টি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা পদের মধ্যে একটি খালি থাকলেও ৩৪টি আরএমও পদের বিপরীতে চিকিৎসক রয়েছে মাত্র ১৪ জন। তাছাড়া জুনিয়র কনসালট্যান্টের ১৭৯টি ও গ্রেড-৯ চিকিৎসকের ৫০৬টি পদের বিপরীতে কর্মরত রয়েছে যথাক্রমে ৯৮ ও ১৪৩ জন। রাজশাহী বিভাগের ৬৬টি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তার পদের বিপরীতে ৬১ জন কর্মরত, ৫৯টি আরএমও পদের বিপরীতে রয়েছে মাত্র ২০ জন, ৪১১টি জুনিয়র কনসালট্যান্ট পদের বিপরীতে ১৫৬ জন কর্মরত এবং ৯৯২টি চিকিৎসক (গ্রেড-৯) পদের বিপরীতে মাত্র ৩১৬ জন কর্মরত রয়েছে। রংপুর বিভাগের অনুমোদিত পদের মধ্যে ৭০ শতাংশই খালি। ওই বিভাগে ৫৩টি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা পদের বিপরীতে ৫০ জন কর্মরত রয়েছে, ৪৬টি আরএমও পদের বিপরীতে ১৩ জন, ৩১২টি জুনিয়র কনসালট্যান্ট পদের বিপরীতে ৯৩ জন ও ৭৯৬টি চিকিৎসক (গ্রেড-৯) পদের বিপরীতে ২০৫ জন কর্মরত রয়েছে। আর ময়মনসিংহ বিভাগ ৩৪টি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা পদের মধ্যে একটি খালি থাকলেও ৩০টি আরএমও পদের বিপরীতে মাত্র ৫ জন কর্মরত রয়েছে, যা সব বিভাগের মধ্যে কম। ২১৬টি জুনিয়র কনসালট্যান্ট পদের বিপরীতে ৭৭ জন এবং ৫৭৭ জন চিকিৎসক (গ্রেড-৯) পদের বিপরীতে ২৩৫ জন কর্মরত রয়েছে। তাছাড়া ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিভাগের শূন্য পদের সংখ্যা সবচেয়ে কম হলেও তা যথাক্রমে ৪২ ও ৫১ শতাংশ। ঢাকা বিভাগে ৮৭টি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা পদের একটিও খালি না থাকলেও ৭৫টি আরএমও পদের বিপরীতে ৩৩ জন কর্মরত রয়েছে। ৫২৪টি পদের বিপরীতে ২৭৯ জন জুনিয়র কনসালট্যান্ট রয়েছে, ১ হাজার ৪৭৪টি চিকিৎসক পদে কর্মরত রয়েছে ৮২৭ জন। আর আয়তনে দেশের বৃহত্তম বিভাগ চট্টগ্রামে ৯২টি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা পদের একটিও খালি না থাকলেও ৮৪টি আরএমও পদের মধ্যে ৫১ জন কর্মরত, ৫২৮টি পদের বিপরীতে ২৭৯ জন জুনিয়র কনসালট্যান্ট, ১৪২০টি পদের বিপরীতে ৬১৫ জন চিকিৎসক (গ্রেড-৯) কর্মরত রয়েছে।
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সংশ্লিষ্টদের মতে, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকদের বদলি ও পদায়ন করা হলে তারা সেখানে থাকতে চান না। বরং চিকিৎসকদের উপজেলা পর্যায়ে বদলি বা পদায়ন করা হলে বিভিন্ন মহলের মাধ্যমে তা ঠেকাতে তদারকি করা হয়। যথাযথ সুযোগ-সুবিধা এবং জেলা ও বিভাগীয় শহর থেকে দূরে হওয়ায় উপজেলা কমপ্লেক্সে চিকিৎসা কাজে আগ্রহী নন চিকিৎসকরা। এক গবেষণা তথ্যানুযায়ী ব্যক্তিগত যৌক্তিকতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতার কারণে গ্রাম বা উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসক চাকরিতে থাকতে চায় না। বেশির ভাগ চিকিৎসকই উপজেলা পর্যায়ে কাজ করতে আগ্রহী নয়। বেশির ভাগ চিকিৎসক ওসব এলাকায় বদলি, পদায়ন ও নিয়োগ ঠেকাতে বিভিন্ন চেষ্টা করে। তারপরও নিয়োগ হয়ে গেলে তারা কর্মস্থলে অনুপস্থিত থাকে। উপজেলা পর্যায়ে কাজে চিকিৎসকের অনীহার বিষয়ে অর্থনৈতিক বিষয়টি জড়িত বলে গবেষণা প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
অন্যদিকে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতে, গ্রামাঞ্চলে চিকিৎসক সংকট দূর করতে আইন ও নিয়ম পুনর্গঠন করতে হবে। নিয়োগের আইন সংশোধন করতে হবে। যে যে উপজেলায় যেতে চান তাকে সে উপজেলায় নিয়োগ দিতে হবে। পাশাপাশি চিকিৎসার যন্ত্রপাতির স্বল্পতাও কমিয়ে আনতে হবে। সর্বোপরি পুনর্গঠন ছাড়া তা সম্ভব নয়।
এ প্রসঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম জানান, উপজেলা পর্যায়ে চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কোনো প্রকার ঘাটতি রাখছে না। চিকিৎসক সংকট রোধে কাজ করতে অধিদপ্তর চেষ্টা করছে। তবে একদিনের বিষয় না। বরং সেটা একটা গতিতে চলবে। কেউ দায়িত্ব অবহেলা করলে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।

Leave a reply

Minimum length: 20 characters ::

More News...

সীতাকুণ্ড উপজেলা সাবেক চেয়ারম্যান রাজু আটক

শ্রমিক নেতা থেকে গুন্ডা বাহিনীর প্রধান হয়েছে শাজাহান খান: আব্দুল মোনায়েম মুন্না